বগুড়ার রহমান নগরের বাসিন্দা (৫৩) কল্যাণ দাস। শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রায় থাকে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে (শজিমেক) যেতে হয়। শহরের মধ্যে দিয়ে সংযোগ সড়ক না থাকায় তাকে ঘুরে যেতে হয় প্রায় ৭ কিলোমিটার। টাকাও খরচ হয় বেশি। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হয় তারমতো সেখানকার বাসিন্দাদের।

কল্যাণ জানান, বগুড়ার সরকারি হাসপাতাল (২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল) থেকে শজিমেক পর্যন্ত শহরের মধ্যে দিয়ে প্রায় ২০ বছর আগে সড়ক নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। অর্ধেক রাস্তার কাজও শেষ। কিন্তু বাকিটা আর শেষ হয় না। আমাদের ভোগান্তিও কমে না। শজিমেকে যেতে যে টাকা ভাড়া লাগে সেই টাকা দিয়ে এখন স্থানীয় ফার্মেসি থেকে নিজের ইচ্ছেমতো প্রায়ই ওষুধ কিনে খাই।

মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল থেকে শজিমেক সংযোগ সড়ক নিয়ে কল্যাণের মতো ক্ষোভ অনেকেরই। চেলোপাড়ার বাসিন্দা শামীমা সুলতানা জানান, সরকারের সুদূর প্রসারী চিন্তা ছিল এই সংযোগ সড়ক। দুই হাসপাতালের রোগীদের চিকিৎসার সুবিধার্থে এই সড়ক অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। এই সড়কের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে শহরবাসী।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন ইসলাম তুহিন বলেন, ‘বগুড়াবাসী মূলত রাজনীতির শিকার। সারা দেশে উন্নয়নের নামে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ এসব প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজখবরও রাখে না। এটা আমাদেরও ব্যর্থতা। এতোদিন আটকে থেকে রাস্তার খরচ বেড়েছে বহুগুণ। এই টাকাও যাবে জনগণের পকেট থেকে। এমন তামাশা বিভিন্নভাবে অনেক উঠে আসছে জনগণের সামনে।’  

বগুড়ার সাধারণ মানুষ এই সংযোগ সড়ক নির্মাণের আশা ছেড়ে দিলেও ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষের আশ্বাস দিয়েছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এই রাস্তার মাত্র ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার কাজ বাকি আছে। এই অংশে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে।  

বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ২০০৪ সালে ছিলিমপুর এলাকায় স্থাপিত হয়। শহরের সাতমাথা থেকে সেখানে যাতায়াতের সরাসরি কোনো সড়ক নেই। মেডিকেল কলেজে যেতে হলে স্টেশন সড়কের তিনমাথা অথবা ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের বনানি হয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। কিন্তু শহরের মধ্যে দিয়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করলে মাত্র আড়াই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই মিলবে সমাধান।  

রোগীদের সেবার কথা বিবেচনায় নিয়ে সাড়ে চার কিলোমিটার সড়কের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। এখন নকশা কাটছাঁটে রাস্তার দৈর্ঘ্য কমেছে। কমেছে প্রস্থও। তবুও বেড়েছে নির্মাণ ব্যয়। শুরুতে প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ খরচ ধরা হয় ৩ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার টাকা। এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৯ কোটি ৪৫ লাখ ৯৪ হাজার টাকায়। অর্থাৎ নির্মাণ খরচ বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ।

ভোগান্তি কমানোর জন্য বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শহরের মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগের জন্য এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তবে ২০ বছরেও এই ভোগান্তির শেষ হয়নি। বরং আটকে আছে এখনো।

শুরুতে (২০০৪ সাল) এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সংযোগ সড়ক। এখন একই সড়কের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল পর্যন্ত সংযোগ সড়ক’।

সওজ বগুড়া কার্যালয় বলছে, বগুড়ার রেলস্টেশন-সেউজগাড়ী-মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল হয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে সহজে যাতায়াতের জন্য ২০০৪ সালে ওই সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন সাড়ে চার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ৬০ ফুট প্রস্থ রেখে নকশা চূড়ান্ত করে সওজ। তখন জমি অধিগ্রহণ, সড়কে মাটি কাটা, কার্পেটিংসহ মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সড়ক বিভাগ এবং ২০০৫ সালের ২ মে পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পটির অনুমোদন চূড়ান্ত হয়। প্রথমে ১ দশমিক ১২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। প্রায় ৮০০ মিটার অংশে মাটি কাটার কাজও শেষ হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি ঝুলে যায়।

সওজ সূত্র জানায়, ২০১১ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পুনরায় প্রাক্কলন তৈরি করা হয়। তখন নকশা সংশোধন করে সড়কটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩৫ ফুট করা হয়। এরপর হঠাৎ বেড়ে যায় এই সড়কের নির্মাণ ব্যয়। ২০১৫ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রাক্কলনে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৭২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে বগুড়া সফরে আসেন। তখন তিনি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, যা দিয়ে ওই ঝুলে থাকা ৮০০ মিটার অংশের কাজ শেষ হয়। কিন্তু পুরো সড়ক আলোর মুখ দেখেনি।

সওজ বগুড়া দপ্তর বলছে, এরপর আরেক দফা নকশা কাটছাঁটের মাধ্যমে নতুন প্রাক্কলন তৈরি করে ২০১৫ সালের অক্টোবরে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে সড়কটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩০ ফুট ধরা হয়। ৮০০ মিটারের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ায় বাকি আছে ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। এর মধ্যেই ২০১৬ সালের জুন মাসে অজ্ঞাত কারণে এই সড়কের ৮০০ মিটার রাস্তা নির্মাণ হওয়ার পর কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সংযোগ সড়ক’ থেকে ‘বগুড়া শহর থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সংযোগ সড়ক’ করা হয়।

পরে এক দশমিক ৮৫ কিলোমিটার অংশের জন্য জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ ও নির্মাণ মিলিয়ে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১০৫ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৭ সালে সম্পত্তি অধিগ্রহণের জন্য আইন হয়। এই আইনে জমির দাম বেড়ে যায়। ফলে এই সড়কে জমি অধিগ্রহণের খরচও বেড়ে যায়। এতে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যায়। এই ব্যয় অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ একনেকে তোলা হয়। এতে প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৭৫ কোটি টাকা ভূমি অধিগ্রহণের জন্য। আর ২৫ কোটি টাকা সড়ক নির্মাণে ব্যয় হওয়ার কথা। তবে শেষ বিশ্লেষণে টাকার পরিমাণ কিছুটা কমে আসে। এখন সড়কটির ১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়ায় ১৮৪ কোটি টাকার ওপরে।

সওজ বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এখন আরও ৬৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ঠিকাদার মাঠেই আছে। আগামী ২০২৪ সালের জুনের মধ্যেই প্রকল্প শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অধিগ্রহণ করা জমি দখল হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এটি বগুড়াবাসীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সওজের কাছে অধিগ্রহণ করা জমির দখল হস্তান্তর করা হবে।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ