প্রযুক্তির প্রভাবে জৌলুস হারিয়েছে লিটনের হাতে আঁকা ছবি
আবু ওবাইদুল হাসান লিটন
নায়িক-নায়িকার ছবি ছাড়া রিকশার বোর্ড হতো না। তাও আবার হাতে গোনা কয়েকজন নায়ক-নায়িকার ছবি। সেই ছবিতে ছিল অ্যাকশান মুহূর্ত। তার সবই হাতের ছোঁয়ায় রং তুলিতে আঁকা। আশির দশকে সব রিকশায় শোভা পেত অভিনেতা রাজ্জাক, জসিম, অভিনেত্রী ববিতা ও সাবানার ছবি। রাজশাহী ছাড়াও একসময় ঢাকার নয়াপল্টনে সাত বছর রিকশার বোর্ডে নায়ক নায়িকাদের ছবি এঁকেছেন আর্টিস্ট আবু ওবাইদুল হাসান লিটন (৬২)। তার হাতের আঁকা ছবি ভারতের শিলিগুড়িতে চলাচল করা রিকশায়ও চিত্রিত করা হয়। তবে দেশে ডিজিটাল মেশিন আশায় হাতে আঁকা ছবির জৌলুস হারিয়ে ধুঁকছে লিটনের মতো আর্টিস্টরা।
রাজশাহী নগরীর রানি বাজারের ফার্নিচার মার্কেটের ‘এভার নিউ পাবলিসিটি’ নামের নিজের একটি দোকানে অলস সময় কাটাতে দেখা গেল একসময়ে নামকরা আর্টিস্ট লিটনকে। এ সময় লিটন দেখালেন নিজের হাতের আকা কিছু ছবি। তবে তার সংগ্রহে রিকশার বোর্ডের কোনো ছবি না থাকলেও বিভিন্ন বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনের ছবি রয়েছে। কাজ না থাকায় ফাঁকা দোকানে চেয়ারে বসে বসে সময় কাটাচ্ছেন তিনি। আগের মতো রিকশা বা বিলবোর্ডে লেখার কাজ না থাকায় লিটন এখন কাজ করছেন, পাথর খোদাই, জার্সি প্রিন্ট, গেঞ্জি প্রিন্ট, ক্যাপ প্রিন্ট, ডিজিটাল নেমপ্লেট ও সাইন বোর্ডের।
বিজ্ঞাপন
রিকশার বোর্ডে ছবি আঁকার বিষয়ে আর্টিস্ট লিটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি সব সময় ভাবতাম। ছবি তো একটা আছেই। এটা তো দেখছি। একই ছবি থেকে কীভাবে ভালো করা যায়, সেই কাজটাই আমি করতাম। অনেক সময় রং পরিবর্তন করে দিতাম। নায়ক নায়িকার পোশাকের রং পরিবর্তন ছাড়াও বিভিন্ন ডিজাইন করে দিতাম। ছবিকে ন্যাচারাল ভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতাম। এই কাজগুলো যে দেখতো, সেই পছন্দ করতো। এই কাজের শুরু ওস্তাদ ছিলেন, লিপিকা অ্যাড ফার্মের ওসমান। তবে মজার বিষয় হচ্ছে। এই ওসমানের গুরু ছিলেন আমার বাবা আবু দাউদ। তার ছবি আকার অনুপ্রেরণা বাবার থেকে। এই কাজে বাবা রাজশাহীর সবার সিনিয়র ছিলেন। রাজশাহীতে যারা কাজ করতেন, তারা মোটামুটি সবাই বাবার শিষ্য ছিলেন। বাবা ভারত থেকে ছবির কাজ শিখে এসেছিলেন। তবে এই কাজ অনেকেই পারলেও এখনও বাবার মতো কেউ পারেন না।
তিনি আরও বলেন, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। শিক্ষার প্রতি তেমন টান ছিল না। পড়াশোনা করে ভালো চাকরি পাব বা করবো এমন কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। ছবি আকার প্রতি টান ও নেশা দুইটাই ছিল। এই নেশা একসময়ে পেশায় পরিণত হয়। আমার ইচ্ছে ছিল ছবি আঁকা পেশা হিসেবে নেব। নিয়েছিও তাই। আমি নিজেই চেয়েছিলাম পেশা হিসেবে। আর চাইবো না কেনো? একসময় বেশ কদর ছিল এই পেশার।
বিজ্ঞাপন
রিকশার বোর্ডে জনপ্রিয় নায়ক নায়িকার ছবি ছাড়া চলতো না বলে লিটন বলেন, আর্টিস্টের জগতে সর্বপ্রথমে আমি রিকশার বোর্ডে (রিকশার পেছনে বিভিন্ন দৃশ্য) সিনেমার দৃশ্য ও নায়ক নায়িকাদের ছবি আঁকতাম। রিকশার পেছনে রাজ্জাক, ববিতা, সাবানা, জসিমের ছবি আঁকতাম। এই কাজের শুরু রাজশাহী থেকে। এই কাজগুলো পুরো রাজশাহী ছাড়াও রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, তেঁতুলিয়া, ভারতের শিলিগুড়িতে যেত। এই অঞ্চলের চলা রিকশাগুলোতে আমার আঁকা ছবি থাকতো। ভারতের শিলিগুড়িতে চলাচল করা রিকশায়ও আমার আঁকা ছবি থাকতো বলে জানান তিনি। তবে মজার বিষয় হচ্ছে তারা লিটনকে দেখেনি। চেনেনও না। তারা রাজশাহী নগরীর ঘোড়ামারা মাখন হুড ও রিকশার বোর্ডের দোকানে যোগাযোগ করতেন কাজের জন্য। মানি অর্ডারে টাকা পাঠাতেন তারা।
এই কাজের বয়স ৪০ বছর উল্লেখ করে লিটন বলেন, আশির দশকে আঁকা ছবির রিকশার বোর্ড বিক্রির ব্যবসা রমরমা ছিল। ভালো লাভ হতো। তখন একটা টিনের (প্লেনসিট) দাম ছিল মাত্র ২২ থেকে ২৩ টাকা। এক কোটা রঙের দাম ছিল মাত্র ৯ থেকে ১০ টাকা। একটা টিন থেকে তিনটা বোর্ড বের হতো। ছোট গোল বোর্ড চারটা হতো। এই গোল বোর্ডগুলোর দাম ছিল ১৫ টাকা। সবমিলে দাম পরতো ১০৫ টাকা। সারাদিন ছয়টা বোর্ড হতো। সেই সময় প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা উপার্জন হতো। রাজশাহীর আশেপাশের জেলায় আমার হাতের আঁকা ছবির বোর্ড চলতো। রাজশাহীতে আরও অনেকেই এই পেশায় থাকলেও কেউ তার মতো ছবির ফিনিসিং আনতে পারতেন না।
আরও ভালো কাজ শেখার উদ্দেশ্যে রাজশাহী থেকে ঢাকায় যাওয়ার বিষয়ে লিটন বলেন, রাজশাহীতে কাজ করতে করতে হঠাৎ ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এরপরে ঢাকার এক বন্ধুর মাধ্যমে যোগাযোগ মুক্তি অ্যাড ফার্মে ও মুক্তি আর্ট ফার্মে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দেই। পরে মুক্তি আর্ট ফার্মে কাজ শুরু করি।
তিনি বলেন, তখন বয়স ছিল ২০ বছর। ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি। ঢাকার মুক্তি আর্ট ফার্মে কাজের সময় অবসরে বিভিন্ন রিকশার ছবি আঁকা দোকানগুলোতে যোগাযোগ করি। দোকান মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তারা আমাকে চারটা বোর্ড দেয় ছবি আঁকার জন্য। সেগুলোতে ছবি এঁকে দেই। ছবি দেখে দোকান মালিক বলেন ‘তুমি মুক্তি অ্যাড ফার্মে চাকরি ছেড়ে দাও। আর কত টাকা নিবা বলো। আমার এখানে চলে আসো।’ আমি তাদের জানিয়ে দেয়- না চাকরি ছাড়তে পারবো না। আপনার এখানে আমি অবসরে কাজ করি।’ তবে মজার বিষয় হচ্ছে সেই সময়ে ঢাকায় যারা ছবি আঁকতো তাদের কাজের মান ভালো ছিল না। তারা পাইকারিভাবে ছবি তৈরি করতো। তাদের ছবির গুণগত মানও ভালো ছিল না।
লিটন আরও বলেন, ১৯৮৭ সালের দিকে রাজশাহী সিটি সিটি করপোরেশন হওয়ার পরে বাবা (আবু দাউদ) বলে রাজশাহী সিটি করপোরেশন হলো। এখন অনেক অফিস বাড়বে। তোমার ঢাকায় থেকে কোনো লাভ নেই। তুমি রাজশাহীতে চলে আসো। রাজশাহীতে অনেক কাজ হবে। তখন রাজশাহীতে চলে আসলাম। রাজশাহীতে আসার পরে অলোকার মোড়ে দোকান দিলাম। দোকানে ছয় থেকে সাত জন কর্মচারী প্রতিদিন কাজ করতো। তখন আমার রমরমা ব্যবসা চলতো। বিভিন্ন অফিস, আদালত, সিটি করপোরেশন ছাড়াও বিভিন্ন জায়গার কাজ পেতাম। একটানা দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছি।
কাজ না থাকায় হতাশার কথা বলতে গিয়ে লিটন বলেন, ডিজিটাল মেশিন আসায় হাতে আঁকা ছবির ব্যবসায় ধস নেমেছে। আমি তবুও ব্যবসা ধরে রেখেছি। তবে ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। এখন পাথর খোদাই, জার্সি প্রিন্ট, গেঞ্জি প্রিন্ট, ক্যাপ প্রিন্ট, ডিজিটাল নেমপ্লেট ও সাইন বোর্ডের কাজ করি। আগে যে জৌলুস ছিল। তার কিছুই নেই। এখন ধুঁকে ধুঁকে জীবন চলছে। বনসাই গাছের মতো। সার পানি দিয়ে কোনো মতে বাঁচিয়ে রাখার মতো। এই পেশার মানুষগুলো বনসাই গাছ হয়ে গেছে। কি করবো এখন বয়স হয়ে আসছে। আর অন্য কোনো কাজও শিখিনি যে পেশা পরিবর্তন করবো। তাই থেকে গেছি এ পেশায়।
শাহিনুল আশিক/এএএ