সকাল হলেই আদালতে দৌড়াতে হয় বিএনপি নেতাকর্মীদের
সকাল হলেই কর্মজীবীরা যেমন কর্মস্থলে যান ঠিক তেমনই সকাল হলেই আদালতে দৌড়াতে হয় সিরাজগঞ্জের বিএনপির নেতাকর্মীদের। জেলায় ৩২১টি মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে তা নিষ্পত্তির জন্য আদালতে বারবার হাজিরা দিচ্ছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। গত ১৫ বছরে হওয়া এসব মামলায় জ্ঞাত-অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ। এদের মধ্যে অনেকেই একাধিক মামলার আসামি হওয়ায় জেলার প্রায় দেড় লাখ নেতাকর্মী মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন। মাসের প্রায় প্রত্যেক দিনই কোনো না কোনো মামলার হাজিরা দিতে আদালতে যেতে হয় তাদের। ঢাকা পোস্টকে এমনটাই জানিয়েছেন জেলার নেতাকর্মীরা।
এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু নামে মামলা আছে ৬৪টি। প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের দায়ের করা মামলায় আসামি হন তিনি। এ সব মামলায় তাকে কারাগারেও যেতে হয়েছে ১৩ বার।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নির্দেশে ও জেলা বিএনপির সভাপতি রুমানা মাহমুদের পরামর্শে মামলা-হামলার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দলের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চুর নেতৃত্বে কেন্দ্র ঘোষিত প্রতিটি কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে যাচ্ছে জেলা বিএনপি। সরকার বিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে জেলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির একাধিক সূত্রে ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
দলটির একাধিক সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও পুলিশের দায়ের করা মামলার দ্বিতীয় শীর্ষ মামলার আসামি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মজিবুর রহমান লেবু। তার নামে রয়েছে ৫৫টি মামলা। জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান তালুকদার রানা ও ভিপি অমর কৃষ্ণ দাস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান রঞ্জন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ সুইটের নামে ৫০টি করে, জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক তানভীর মাহমুদ পলাশের নামে রয়েছে ৪০ এর অধিক মামলা।
জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ভিপি শামীম খানের নামে ৪০, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুন্সী জাহেদ আলমের নামে ৩৫, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা মোস্তফা জামানের নামে ২০, জেলা যুবদলের সভাপতি মির্জা আব্দুল জব্বার বাবুর নামে ৪৭, সাধারণ সম্পাদক মুরাদুজ্জামান মুরাদের নামে ৪০, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন রাজেশের নামে ৫০, বর্তমান আহ্বায়ক আব্দুল্লাহ আল কায়েসের নামে ৩০, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি জুনায়েদ হোসেন সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক সেরাজুল ইসলাম সিরাজের নামে রয়েছে ৩০টি করে মামলা। এ ছাড়া দলটির আরও কয়েক ডজন শীর্ষ নেতার নামে ২০ থেকে ৩০টি করে মামলা রয়েছে। এসব মামলায় নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতসহ রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রায় প্রতিদিনই হাজিরা দিতে হয় এসব নেতাদের।
সূত্রে আরও জানা যায়, এসব মামলায় ১৩ বার কারাগারে গিয়েছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু, ৭ বার কারাগারে গিয়েছেন জেলা যুবদলের সভাপতি মির্জা আব্দুল জব্বার বাবু ও ৪ বার কারাগারে গিয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান রঞ্জন। এছাড়াও, অধিকাংশ নেতাই কয়েকবার করে জেল খেটেছেন।
এর মধ্যে রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলায় সাতজনকে যাবজ্জীবন ও নয়জনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত নেতারা হলেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ সুইট, বিএনপি কর্মী আব্দুল মোমিন, আনিছুর রহমান, আব্দুল আলীম, বাবু, মোতালেব ও ছাত্রনেতা সবুজ। এ ছাড়া পাঁচ বছরের সাজাপ্রাপ্ত নেতাদের মধ্যে রয়েছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর আলম ওরফে প্যাটেল আলম, সহ-সভাপতি লুৎফর ভুইয়া, বিএনপি নেতা জুড়ান আলী, বাবুল সেখ, ইসমাইল হোসেন, মোস্তাকিন, জিয়া হাসান প্রমুখ।
জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক তানভীর মাহমুদ পলাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে গত ১৫ বছরে মোট ৩২১টি মামলা হয়েছে। এতে জ্ঞাত-অজ্ঞাত প্রায় ১০ লাখ আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই একাধিক মামলার আসামি হওয়ায় জেলার প্রায় দেড় লাখ নেতাকর্মী মামলার বোঝা নিয়ে চলছেন। এসব রাজনৈতিক মামলা বিচারাধীন থাকায় নেতাকর্মীদের প্রতিদিনই কোনো না কোনো মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আমার নিজের নামেও ৪০ এর অধিক মামলা রয়েছে।
জেলা যুবদলের সভাপতি মির্জা আব্দুল জব্বার বাবু ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৫ বছরে শুধু আমার নামেই দেওয়া হয়েছে ৪৭টি মামলা। এসব মামলার মধ্যে থেকে এখন আবার আলাদা করা হয়েছে। যেমন বিস্ফোরণ মামলা আলাদা করে বিচার শুরু করা হয়েছে। এভাবে মামলা আলাদা হওয়ার পরে এখন মামলা দাঁড়িয়েছে ৬৫ তে। এ সব মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে ৭ বার। তিনি বলেন, শুধু আমি নই, আমাদের বেশিরভাগ নেতাকর্মীকেই এমন অসংখ্য হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ সব মামলায় হাজিরা দিতে প্রায় প্রত্যেক দিনই আমাদের আদালতে যেতে হচ্ছে। মামলা-হামলা করে নানানভাবে আমাদের হয়রানি করে যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী সরকারের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে আসছে বিএনপি। আওয়ামী শাসনামলে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক এমপি রুমানা মাহমুদ তিন দফায় হামলার শিকার ও গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের গুলিতে দু-চোখ হারিয়ে চিরজীবনের মতো অন্ধত্ব বরণ করেছেন জেলা মহিলা দলের সহ-সভাপতি মেরিনা সুলতানা মেরী ও জেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম হোসেন হিটলার। ক্রসফায়ারে মারা যান বিএনপি নেতা জবান আলী ও বাবলু। এছাড়া অসখংখ্য নেতাকর্মী আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের হামলা-নির্যাতনে আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। তারপরও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নির্দেশে ও জেলা বিএনপির সভাপতি রুমানা মাহমুদের পরামর্শে হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে দলের প্রতিটি কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে যাচ্ছি।
আরও পড়ুন
মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্ররা যখন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ছোটে, চাকরিজীবীরা অফিসের উদ্দেশে ছুটে চলেন, নানান পেশার মানুষ যখন তাদের নিজ নিজ কর্মের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন, তখন অর্ধশতাধিক মামলা মাথায় নিয়ে প্রতিদিনই আদালতের বারান্দায় ছোটাছুটি করতে হয়। মাসে গড়ে ২০টিরও অধিক মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে হিমশিম খেতে হয়। তিনি বলেন, চলতি মাসে ২৩টি মামলার হাজিরা দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো কোনো দিন ৩-৪টি মামলার হাজিরা থাকে। এ সব মামলায় আবার হাজিরা দিতে গিয়ে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। যার ফলে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। কিছু কিছু মামলায় সাজা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দ্রুত নিষ্পত্তি করার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন সাইদুর রহমান বাচ্চু।
তিবি ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, তারা ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের নামে মামলা দেয়। গত তিনদিন আগেও সদরের ছোনগাছা এলাকায় লিফলেট বিতরণকালে আমাদের ওপরে তারা হামলা করে এবং এখন আমাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি দাবি করেন, বিরোধীদলের ওপর হামলা-মামলা, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। মিথ্যা, রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে দায়ের করা সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
এএএ