‘জাহেদুল, আমার জাহেদুল কই, আমার জাহেদুলরে এনে দাও। আমার মানিক, আমার বাবা জাহেদুল কই! আমার জাহেদুল আমাকে চিন্তা করতে মানা করছে, ভাত খেতে বলছে। আমার জাহেদুল আমার সঙ্গে কথা কয় না কেন! জাহেদুলরে এনে দাও, আমার বাবারে এনে দাও।’

বাড়ির উঠানে বসে জাহেদুলের মরদেহ এক নজর দেখার জন্য তিন দিন ধরে এভাবেই মাতম করছেন তার মা আলেয়া বেগম। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ঋণ করে ছেলেকে মালেশিয়া পাঠিয়েছিলেন নিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ম্যানহোলের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে মাটিচাপায় মারা গেছেন জাহেদুল। বিদেশে ছেলের মৃত্যু হয়েছে, মরদেহ ফিরে পাবে কিনা এই দুশ্চিন্তায় আলেয়া বেগমের এমন আহাজারি। একই ঘটনায় জাহেদুলের সঙ্গে আরও দুই বাংলাদেশি যুবক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যে সাজ্জাদের বাড়ি জাজিরা পৌরসভা এলাকায়। মনিরুল নামে অন্যজনের বাড়ি পাবনায়।

শনিবার (৪ নভেম্বর) সকালে শরীয়তপুরের জাহেদুল খান ও সাজ্জাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের এমন কান্নার আহাজারি দেখা যায়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টা ৩০ মিনিটের দিকে মালয়েশিয়ার কেলাস্তান রাজ্যের কাম্পুং মাকা এলাকার মাজদা শহরের ম্যানহোলের নির্মাণকাজ করতে গিয়ে মাটিচাপায় মারা যান তিন যুবক।

নিহত জাহেদুল খান (২০) শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিকন্দী ইউনিয়নের দক্ষিণ কেবল নগর গ্রামের আব্দুর রশিদ খান ও আলেয়া বেগম দম্পতির ছেলে। সাজ্জাদ হোসেন উবি (২০) জাজিরা পৌরসভার আহাদী মাদবর কান্দির শাহজাহান উবি ও নুরহাজান বেগম দম্পত্তির ছেলে। এছাড়া মনিরুল (৩১) পাবনা জেলার বাসিন্দা।

স্থানীয় ও নিহতদের স্বজনরা জানান, জাহেদুল খান চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়া পাড়ি জমিয়েছিলেন। মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে তিনি দর্জির কাজ করতেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে জাহেদুল সবার ছোট। সাজ্জাদ হোসেন জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর ইউনিয়নের কাজিয়ারচর এলাকার উবি কান্দি গ্রামের বাসিন্দা হলেও গত ১০ বছরে তিনবার নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে জাজিরা পৌরসভার আহাদি মাদবর কান্দি গ্রামে এসে বসতি করেছেন। বারবার নদীতে বাড়ি ভাঙনে আর্থিকভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়া পরিবারটি ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে একটু সচ্ছল হওয়ার চিন্তা করেছিল। কিন্তু দুর্ঘটনায় সব কিছু শেষ হয়ে গেছে।

জাহেদুল খানের ভাই মো. রাসেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পেরেছি আমার ভাই মারা গেছে। আমাদের আর কিছু বলার নেই। জাহেদুলের মরদেহটি যেন আমরা ফেরত পাই।

মিজানুর রহমান নামে আরেক ভাই বলেন, ফেসবুকে সংবাদ পেয়ে প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে মুঠোফোনে আমার মামাতো ভাই জানিয়েছে জাহেদুল মারা গেছে। সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ, আমার ভাইয়ের মরদেহটা যেন ফেরত পেতে পারি।

জাহেদুল খানের মা আলেয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জাহেদুল কয়দিন আগে বিদেশে গেল। আপনারা আশপাশের এলাকায় খবর নেন, আমার জাহেদুল কত ভালো ছিল। আমার ছেলেকে আমার কাছে এনে দেন। আমার জাহেদুলরে আমি দেখতে চাই। আমি আর কিচ্ছু চাই না, আমার জাহেদুল... আমার বাবা।

সাজ্জাদ হোসেনের বাবা শাহজাহান উবি। ইনসেটে সাজ্জাদ হোসেন 

অন্যদিকে একই চিত্র জাজিরা পৌরসভার আহাদী মাদবর কান্দি গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন উবির বাড়িতে। তার বাবা শাহজাহানের একটাই দাবি, ছেলের মরদেহ ফিরে পাওয়া। পদ্মার ভয়াল ভাঙনে তিনবার ভিটেমাটি হারিয়ে তিনি পৌরসভা এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন। সাজ্জাদ বিদেশে যাওয়ার আগে নারায়ণগঞ্জের একটি টেক্সটাইলে শ্রমিকের কাজ করতেন। পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে সাজ্জাদকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছিলেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। মাত্র ২৫ দিন আগে ম্যানহোলের কাজ করতে গিয়েছিল সে। মাটিচাপায় সেখানে সাজ্জাদ মারা গেছে।

সাজ্জাদ হোসেনের বড় চাচা ইদ্রিস উবি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাজ্জাদ দেশে যখন ছিল, মনোযোগ দিয়ে সংসারের কাজ করত। কয়েক মাস আগে মালয়েশিয়া গিয়েছিল। সেখানে মাটিচাপায় তার মৃত্যু হয়েছে। ওর মরদেহ দেশে এনে মাটি দিতে চাই। আর কিছু চাওয়ার নেই।

সাজ্জাদ হোসেনের ভাই শাকিল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সে মালেশিয়া গিয়েছিল। নির্মাণকাজ করতে গিয়ে সে মাটিচাপায় মারা গেছে। সাজ্জাদের মরদেহটা দেশে এনে দাফন করতে চাই। সরকারের কাছে এই আবেদন ছাড়া আর কিছু বলার নেই।

সাজ্জাদ হোসেনের বাবা শাহজাহান উবি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে আমাকে রেখে চলে গেল। আমার ছেলের মরদেহটা দেশে এনে নিজ হাতে দাফন করতে চাই। সরকারের কাছে আমার এই একটাই দাবি।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র ও জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাহেদুল ও সাজ্জাদ মালয়েশিয়াতে মৃত্যুবরণ করেছে বলে খবর পেয়েছি। তারা যে মালয়েশিয়াতে গিয়েছিল, তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। এখন খোঁজ খবর নিয়ে তাদের মরদেহ দেশে আনতে উপজেলা প্রশাসন সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।

সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/এমজেইউ