স্বাদে-মানে অতুলনীয় মানিকগঞ্জের ‘পলাশের পানতোয়া’। স্থানীয়দের কাছে এই মিষ্টি খুবই প্রিয়। শুধু জেলাজুড়েই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভোজনরসিকদের কাছেও স্বাদে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে এই পানতোয়া।

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে মিষ্টির ব্যবসা করে আসছে মানিকগঞ্জ জেলা শহরের ঘোষ পরিবার। বাবার  পেশাকে এখনো ধরে রেখেছেন স্বপন কুমার ঘোষ। মানিকগঞ্জ শহর বাজারের লক্ষ্মীমণ্ডপ এলাকায় পলাশ মিষ্টান্ন ভান্ডার নামে দোকানে পাওয়া যায় বিশেষ ধরনের সুস্বাদু এই নরম পানতোয়া মিষ্টি। দোকানের পেছনেই তৈরি করা হয় এই মিষ্টি। বিশেষ এই মিষ্টিটি পরিচিতি পেয়েছে ‘পলাশের পানতোয়া’ নামে।

প্রথমে দুধ থেকে ছানা তৈরি করা হয়। এরপর সেই ছানা ঘি দিয়ে ভেজে চিনির রসে ডুবিয়ে তৈরি করা হয় পানতোয়া মিষ্টি। পূর্বপুরুষদের মিষ্টির দোকানটি এখনো ধরে রেখেছেন স্বপন। প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি বিশেষ এই পানতোয়া মিষ্টি তৈরি করে আসছেন। ধরে রেখেছেন মিষ্টির মান।

সরেজমিনে পলাশ মিষ্টান্ন ভান্ডারে পুড়ি, সিঙারা, সমুচা এবং মিষ্টি বেচাকেনায় কর্মচারীদের ব্যস্ততা দেখা গেছে। কর্মচারীদের সঙ্গে দোকান মালিক স্বপন ঘোষও বসে নেই, বেচাকেনায় কর্মচারীদের সঙ্গে তিনিও সহযোগিতা করছেন। কাজের ফাঁকে আলাপ হয় তার সঙ্গে। এ সময় তিনি জানান, মিষ্টি তৈরি তাদের আদি পেশা। তার বাড়ি পৌরসভার পূর্ব-দশড়া এলাকায়। 

জানা গেছে, স্বপন ঘোষের বাবা বুদ্ধমন্ত ঘোষ ১৯৬০ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর তার ভাই কালীপদ ঘোষ ও স্বপন ঘোষ সেই মিষ্টির ব্যবসায় যুক্ত হন। তখন কালীপদ ঘোষের ছেলের (স্বপনের ভাতিজা) পলাশ ঘোষের নামেই দোকানের নামকরণ করা হয় ‘পলাশ মিষ্টান্ন ভান্ডার’। দুই ভাইয়ের মিষ্টির ব্যবসায় বেশ ভালোই চলছিল। তবে পরবর্তীতে কালীপদ ঘোষ পাশেই আরেকটি দোকান নিয়ে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে পালাশ মিষ্টান্ন ভান্ডার স্বপন ঘোষই পরিচালনা করেন।

বিশেষভাবে তৈরি করা পানতোয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপন ঘোষ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ১৯৮৯ সালে মেট্রিক (এসএসসি) পরীক্ষা দিয়ে স্বজনদের সঙ্গে ভারতের কলকাতায় বেড়াতে যাই। সেখানে কালীপূজায় বিশেষ ধরনের মিষ্টি পানতোয়া দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। দোকানে বসে সেই মিষ্টি খেয়ে এক ধরনের বিশেষ স্বাদ উপভোগ করি। এরপর ২০০০ সালের শুরু দিকে আমি পানতোয়া তৈরি শুরু করি। মিষ্টির স্বাদ ও ঘ্রাণের কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই ক্রেতা ও চাহিদা দুটোই বাড়তে থাকে। জেলাজুড়ে আমার দোকানের তৈরি পানতোয়ার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই জেলা শহরের লোকজনের মুখে মুখে ‘পলাশের পানতোয়া’র সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন ১০০ কেজির বেশি পানতোয়া মিষ্টি তৈরি করা হয়। আবার চাহিদা বেশি থাকলে বা কোনো অর্ডার থাকলে ১২০ কেজি থেকে ১৩০ কেজিও তৈরি করা হয়। প্রতি পিস পানতোয়ার দাম ৪০ টাকা আর প্রতি কেজি ৩৬০ টাকা থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এখন শুধু জেলাজুড়েই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও আমার তৈরি এই পানতোয়ার কদর রয়েছে। কেউ বেড়াতে আসলেও পানতোয়া কিনে নিয়ে যান, আবার অনেকে লোকমুখে শুনেও আমার দোকানে আসেন এবং কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমেও পানতোয়া কিনে নেন।

বিশেষ ধরনের পানতোয়া মিষ্টি তৈরির কাজে ব্যস্ত কারিগর বাবুল দত্ত। আলাপকালে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে মিষ্টি তৈরির কাজ করছি। প্রতিদিন সকালে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দুধ নিয়ে আমাগো এই দোকানে আসেন দুধ ব্যবসায়ীরা। সাত থেকে আট মণ দুধ কেনা হয় প্রতিদিন। সেই দুধ চুলায় জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ছানা। এরপর সেই ছানা দিয়ে গোলাকৃতির মতো তৈরি করে ঘিয়ে ভাজা হয়। পরে পানি ও চিনির তৈরি শিরায় মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হয় ভাজা সেই ছানা। এভাবেই তৈরি করা হয় সুস্বাদু ও নরম পানতোয়া। যা ‘পলাশের পানতোয়া’ নামে খ্যাত।

আরেক কারিগর মোহাম্মদ দাউদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বপন দার মিষ্টির দোকানে ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করি। দোকানে অন্যান্য কাজও করি, তয় মিষ্টি বানানো মূল কাজ। আমাগো দোকানের পানতোয়া মিষ্টির বেশ চাহিদা আছে, স্বাদ আর সুনামও রয়েছে।

জেলা শহরের বাসিন্দা তারিকুল হাসানসহ বেশ কয়েকজন দোকানে বসে পানতোয়া খাচ্ছিলেন। তারিকুল হাসান বলেন, মাঝে-মধ্যেই দাদার দোকানে পানতোয়া খাওয়ার জন্য আসি। এই দোকানের পানতোয়ার স্বাদ ও মান ভালো। স্কুলে লেখাপড়ার সময় যে স্বাদ পেতাম, এখনো পানতোয়ার স্বাদ তেমনি আছে।

জেলা শহরের পশ্চিম দাশড়া এলাকায় বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এসেছেন পলাশ মোল্লা। তিনি বলেন, আমার বাড়ি গোপালগঞ্জের মকসুদপুরে। এখানে বন্ধু আহাদের বাসায় বেড়াতে আসছি, ওর কাছেই শুনলাম এই মিষ্টির সুনাম। নিজে একটি পানতোয়া খেয়ে বাড়ির জন্য চার কেজি পানতোয়া কিনেছি।

জেলা ক্যাবের সভাপতি গোলাম ছারোয়ার বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েক জায়গায় বিশেষ এই পানতোয়া মিষ্টি তৈরি করা হয়। আমাদের দেশেও কয়েকটি স্থানে এই মিষ্টি তৈরি হয়। তবে ‘পলাশের পানতোয়া’ স্বাদে ও মানে ভালো হওয়ায় জেলার বাহিরের অনেকে এই পানতোয়া কিনতে চলে আসেন। আমিও মাঝে মধ্যেই এই পানতোয়া খাই। আর পানতোয়া মিষ্টি তৈরির কারিগররা দীর্ঘ দিন ধরে স্বাদ ও মান ধরে রেখেছেন বলেই এখনো ‘পলাশের পানতোয়া’ মিষ্টির চাহিদা অনেক।

আরএআর