খাদ্য কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ

খাদ্য কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদের বাস ভবন থেকে ১৩ বস্তা চাল ও এগারো শ চালের বস্তা জব্দ করার পর সেই ভবনটি সিলগালা করে দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর তিনি জানালার গ্রিল কেটে সেই চালের বস্তা সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এবার তদন্ত প্রতিবেদনে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বাজার থেকে ১৮ টন চাল কিনে এনে গুদামের ঘাটতি পূরণ করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

সরকারি বাসভবনে অবৈধভাবে চাল মজুদ ও গ্রিল কাটার বিষয়টি তদন্ত করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে সেই কমিটির জ্ঞাতসারেই অন্য জায়গা থেকে চাল এনে গুদামের ঘাটতি পূরণ করার একটি ভিডিও এসেছে ঢাকা পোস্টের কাছে। 

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, একই বিভাগে চাকরি করি বলে তাকে একটু সুযোগ দিয়েছি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে খাদ্য গুদামে চালের ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়নি বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। এছাড়াও ইকবাল মাহমুদকে ঘটনার সুরাহার আগেই রাজবাড়ির জেলার পাংশা উপজেলায় বদলি করা হয়। এতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়রা হতাশ হয়েছেন।

জানা গেছে, খাদ্য কর্মকর্তার ভবন থেকে চালের বস্তা উদ্ধার ও পরে জানালার গ্রিল কেটে বস্তা সরানোর চেষ্টা করার ঘটনার বিষয়ে তদন্ত করতে ১৩ নভেম্বর ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। এতে সদস্য করা হয় ভেদরগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. নুরুল হক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান ও জাজিরা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সেলিম আহমদকে। 

তদন্তকালীন সময়ে খাদ্য গুদামে ১৮ টন চালের ঘাটতি ছিল। তিন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিলে গত ১৪ নভেম্বর ১০ টন ও ১৫ নভেম্বর ৮ টন চাল ট্রাকে করে বাইরে থেকে এনে খাদ্যগুদামে রেখে ঘাটতি পূরণ করেছেন। বিষয়টি ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানতে পেরে ওই তদন্তকারী তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলে তারা বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পরে ১৬ নভেম্বর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে খাদ্যগুদামে চালের কোনো ঘাটতি নেই বলে উল্লেখ করা হয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উপজেলা খাদ্যগুদামের নিরাপত্তা প্রহরী মোক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইকবাল মাহমুদ স্যার আসার পর যখন গোডাউন থেকে চাল সরিয়ে খাদ্য কর্মকর্তা তার বাসায় রাখেন আমি তার বিরোধিতা করি। পরে আমি বিষয়টি ডিসি ফুড স্যারকে জানালে তিনি উল্টো আমাকে চুপ থাকতে বলেন। তারপর হঠাৎ ইউএনও স্যার ইকবাল মাহমুদ স্যারের বাসা থেকে চাল জব্দ করে বাসা সিলগালা করে দেয়। তার পরের দিন ইকবাল মাহমুদ স্যার সন্ধ্যায় মিস্ত্রি এনে বাসার গ্রিল কেটে আরেক নিরাপত্তা প্রহরী আবু হানিফকে নিয়ে বস্তা বের করার চেষ্টা করেন। তখন ইউএনও স্যার চলে আসলে আবু হানিফ কিছু বস্তা আর বাজারের একটি ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়। ওই ব্যাগ টাকায় ভর্তি ছিল। যা গ্রিল মিস্ত্রি দেখেছে বলে আমাকে জানায়।

বাইরে থেকে গুদামে চাল নিয়ে ঘাটতি পূরণ করার বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই গোডাউনে ট্রাকে করে চাল ঢুকেছে, যা আমি নিজে দেখেছি। এছাড়াও ইকবাল মাহমুদ স্যার গোডাউন থেকে মাঝে মাঝে চাল বিক্রি করেন। চাল কম পাওয়ায় চেয়ারম্যান ও ঠিকাদারদের সঙ্গে ইকবাল মাহমুদ স্যারের মাঝেমধ্যে তর্কবিতর্ক হত।

খাদ্যগুদামের নিরাপত্তা প্রহরী আবু হানিফ খান (রুবেল) টাকার বিষয়টি অস্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বাসার গ্রিল কেটে জামা কাপড়ের ব্যাগ ও মোবাইল নিয়ে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ওই ব্যাগে কোনো টাকা ছিল না।

এসব ঘটনার মূল অভিযুক্ত খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল বের করার জন্য গ্রিল কেটেছিলাম। কিন্তু বস্তা বের করার জন্য কাটিনি। খাদ্যগুদামের মালামাল পরিপূর্ণ রয়েছে, কোনো ধরনের ঘাটতি নেই।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও জেলা কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা একই বিভাগে চাকরি করেছি। তাকে একটু সুযোগ দিয়েছি বলতে পারেন। তবে তিনি বাইরে থেকে চাল এনে ঘাটতি পূরণ করেননি। ১৮ টন নয় বরং ৮ টন চাল ঘাটতি ছিল। যা ১ নম্বর গুদাম থেকে এনে ৪ নম্বর গুদামে রাখা হয়েছে। খাদ্যগুদামের ভেতর চাল নিয়ে আসার সময়কার গোপনে ধারণকৃত ওই ভিডিওতে মিজানুর রহমানকে দেখা গেলেও তিনি তা অস্বীকার করেন।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. নুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউএনও স্যার যে ১৮ টন চালের কথা বলছেন, তার কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। বরং এই বিষয়টি ইউএনও স্যারের কাছেই শুনেছি আমরা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চাল নেওয়া হয়েছে এমন কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, হিসেব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ইকবাল মাহমুদ এক গুদাম থেকে অন্য গুদামে চাল নিয়েছেন।

ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গুদামে ১৮ টন চালের ঘাটতি ছিল। গুদামে যে চালের ঘাটতি ছিল, খাদ্যগুদামে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে বাইরে থেকে চাল কিনে গুদামের ভেতরে এনে ঘাটতি পূরণ করেছেন। পর্যাপ্ত তথ্য আমার হাতে থাকার কারণে তদন্ত কর্মকর্তা তিনজন ও খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন আইনে ব্যবস্থা নিতে দুদকে আমি চিঠি দিয়েছি। এছাড়া জেলা প্রশাসক মহোদয় সচিব বরাবর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি লিখেছেন। 

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ইকবাল মাহমুদের কাজের কারণে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য লিখেছি। দ্রুতই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাকে রাজবাড়ী পাংশায় বদলি করা হয়েছে। খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুমে যে ১৩ বস্তা চাল পাওয়া গেছে তা অবৈধ মজুদ। এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে খাদ্যগুদামের মালামাল পরিপূর্ণ রয়েছে, কোনো ঘাটতি নেই। নতুন যে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসেছেন তিনি সব সঠিক পেয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঘাটতি চাল পূরণের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

সাইফুল ইসলাম সাইফ রুদাদ/এএএ