ঐতিহ্য চেনাতে ৩০ বছর ধরে বায়োস্কোপ নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরছেন মাইন
পরনে রঙবেরঙের পোশাক। মাথায় রঙিন চুল, মুখে জোকারের মুখোশ পরে ছোট-বড় সবাইকে বায়স্কোপ দেখাচ্ছেন। যেকোনো মেলাতেও এমন দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। এক সময়কার গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিনোদন ছিল এই বায়োস্কোপ। যেটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু এই বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে ৩০ বছর ধরে বায়োস্কোপ দেখিয়ে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের আনন্দ দিয়ে চলেছেন মো. মাইন উদ্দিন (৫০)। মানুষকে এভাবে বিনোদন দিয়েই চলছে তার সংসার ও জীবন যাত্রা।
নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় দেখা মিলল মাইন উদ্দিন ও তার বায়োস্কোপের। দেশের বিভিন্ন জেলায় ঐতিহ্য চেনাতে বায়োস্কোপ নিয়ে ঘুরে বেড়ান তিনি। মাইন উদ্দিন কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার আলীপুর গ্রামের মো. কাশেমের ছেলে।
বিজ্ঞাপন
এক সময় গ্রামাঞ্চলে বায়োস্কোপের ব্যাপক প্রচলন ছিল। কাঁধে বায়োস্কোপের বাক্স ঝুলিয়ে ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে যেত বায়োস্কোপ চালনাকারী। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো পেছন পেছন ছুটতো শিশু-কিশোররা। চাল বা সামান্য কিছু টাকা দিলেই দেখাতেন বায়োস্কোপ। গ্রামগঞ্জে, হাটে, মেলায়, অনুষ্ঠান ছাড়াও পাড়া-মহল্লায় বায়োস্কোপ দেখানো হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির যুগে বায়োস্কোপ এখন বিলুপ্তপ্রায়। রঙিন টেলিভিশন, স্যাটেলাইট চ্যানেলের বিনোদনের ভিড়ে আর দেখা মেলে না বায়োস্কোপের।
বিজ্ঞাপন
এই প্রযুক্তির যুগেও বায়োস্কোপের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা মাইন উদ্দিনের স্ত্রী, এক ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। তিনি ঢাকার গাজীপুরে থাকেন। দীর্ঘ ৩০ বছর যাবৎ বায়োস্কোপ দেখিয়ে তিনি সংসার চালিয়ে জীবন-যাপন করছেন। আগে বিভিন্ন হাট-বাজারে দর্শকদের বায়োস্কোপ দেখিয়ে আয় হলেও বর্তমানে আর তেমন আয় হয় না। তবে বিবাহ, গায়ে হলুদ ও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলে ভালো টাকা আয় করেন।
সরেজমিনে নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় দেখা গেছে, মাইন উদ্দিনের বায়োস্কোপ ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। কেউ কেউ বায়োস্কোপের ছবি তুলছে কেউ আবার ভিডিও করছে। পরনে রঙবেঙের পোশাক ও মাথায় রঙিন চুল থাকায় কেউ আবার মাইন উদ্দিনের সঙ্গে ছবিও তুলছেনবি। অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে থেকে শিশুদের দেখাচ্ছেন বায়োস্কোপ।
ইসরাত জাহান নামের এক স্কুল শিক্ষার্থী বায়োস্কোপ দেখে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আগে কখনও বায়োস্কোপ দেখিনি এবারই প্রথম দেখলাম। সবার কাছে বায়োস্কোপের গল্প শুনেছি আজ দেখলাম সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। অনেক কিছু দেখলাম এর মধ্যেও অনেক কিছু শেখার আছে।
মাইন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে বায়োস্কোপের সঙ্গে আছি। আগে ছিল রিল সিস্টেম এখন ডিজিটাল হয়েছে। গায়ে হলুদসহ নানা অনুষ্ঠানে বায়োস্কোপ দেখাই। বায়োস্কোপে আমি বাংলাদেশের কিছু ঐতিহ্য রেখেছি। গরুর গাড়ি, পালকি, সুন্দরবন, পদ্মা সেতু, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ছবি দি। একটা গল্পও রেখেছি এই বায়োস্কোপে। এই বায়োস্কোপটা আমি নিজেই বানিয়েছি।
মাইন উদ্দিন আরও বলেন, আমি ঢাকা আসছি মানুষজনকে বায়োস্কোপ চেনাতে। যা আয় হয় তা দিয়ে চলা যায় না। এক হাজার বা ১২শ টাকা হয় দিনে। অনেকে নামই শুনছে কিন্তু দেখে নাই। বাস্তবে বায়োস্কোপ দেখাতে আমি ঘুরে বেড়াই। খেয়ে দেয়ে আমার সমান সমান হলেও আমি এই বায়োস্কোপ দেখিয়ে যাব। এই ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দেব না। কেউ দেখুক না দেখুক এটা তাদের বিষয়। তবে আমি ঐতিহ্য ধরে রেখেছি এটাই আমার স্বার্থকতা।
আইনজীবী এমদাদ হোসেন কৈশোর ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল ও ইন্টারনেটের যুগে এই বায়োস্কোপ দেখানো হচ্ছে এটাই বিশেষত্ত্ব। একদিকে ইন্টারনেট আরেকদিকে বায়োস্কোপ। হারিয়ে যাওয়া বায়োস্কোপ নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলায় এসে দেখতে পাচ্ছি। এটাই আমাদের বেশ ভালো লাগার একটা বিষয়।
হাসিব আল আমিন/আরকে