৭ জানুয়ারি নির্বাচনকে ঘিরে প্রচার-প্রচারণায় পিছিয়ে নেই নারী প্রার্থীরা। রংপুর জেলার ছয়টি আসনে ৩৬ জন প্রার্থীর মধ্যে তিন নারীও রয়েছেন ভোটযুদ্ধে। এর মধ্যে রংপুর-৬ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী (নৌকা), একই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাকিয়া জাহান চৌধুরী (কাঁচি) ও রংপুর-১ আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের শ্যামলী রায় (ডাব) নির্বাচনের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তারা কোনোভাবেই পুরুষ প্রার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে নেই। কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে পাড়া-মহল্লায় ঘুরছেন, বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন নিজেদের মার্কা। ভোটারদের মনে জায়গা পেতে কুশল বিনিময়ের সঙ্গে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতিও।

এদিকে নারী প্রার্থীরা যেমন ছুটছেন, তেমনি ছুটছেন পুরুষরাও। প্রচার-প্রচারণার মাত্রা কমবেশি হলেও ভোটের আমেজ রয়েছে সবখানে। দুপুরের পর থেকেই মাইকে বাজছে সুরে সুরে প্রার্থীদের গুণকীর্তন আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। নারী ভোটারদের পক্ষে টানতে মাঠে নেমেছেন প্রার্থীদের মা, স্ত্রী-কন্যা। এ ছাড়া নারী কর্মীরাও প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। পাশাপাশি উন্নয়ন, নারীর অধিকার এবং নারী কেন্দ্রিক প্রার্থীদের অঙ্গীকারগুলো তুলে ধরছেন তারা।

জেলার মোট ভোটার ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৫০৫ জন। এর মধ্যে ১২ লাখ ২০ হাজার ৩৯৪ জন নারী ভোটার। বিপুল সংখ্যক নারী ভোটারকে পক্ষে টানতে নারী কর্মীদেরকে টার্গেট করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বরাবরের মতো এবারও প্রচারণার জন্য পুরুষ কর্মীদের পাশাপাশি নারী কর্মীদেরও বেছে নিয়েছেন প্রার্থীরা। খরচ কম হওয়ায় এই পন্থা অবলম্বন করেছেন বলে জানিয়েছেন অনেক পুরুষ কর্মী। তবে প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে নারী কর্মীরা এগিয়ে থাকলেও তাদের পারিশ্রমিক খুব কম বলে অভিযোগ করেছেন অনেক নারী কর্মী। দিনরাত প্রচারণা চালাচ্ছেন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সভা-সমাবেশেও অংশ নিচ্ছেন এসব নারী।

এদিকে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখা গেছে, আলো ঝলমলে শহর কিংবা মরা তিস্তার চর সর্বত্র বইছে নির্বাচনী হাওয়া। শীতের তীব্রতা ম্লান হচ্ছে ভোটের ডামাডোলে। শিশির ভেজা সকাল থেকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা মাঝরাত অবধি চলছে তৃণমূলের কর্মী, সমর্থক আর সাধারণ ভোটারদের আড্ডা। এতে বাদ পড়েনি প্রার্থীদের স্বজনদের নারী কেন্দ্রিক প্রচারণা। ফলে নারী ভোটাররা বেশ প্রভাবিত হচ্ছেন। বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে নিলেও ভোটাররা জানিয়েছেন বিজয়ী হয়েও যেন তারা ভোটারদের কাছে আসেন। সুবিধা-অসুবিধা জেনে উদ্যোগ নেন।

নারী ভোটাররা জানিয়েছেন, প্রার্থীদের পক্ষে তাদের স্বজনেরা ইশতেহার তুলে ধরছেন। ভোটে জিতলে নারীদের উন্নয়নে কি কি কাজ করবেন এসব বুঝাচ্ছেন। রংপুর-১ আসনের গজঘন্টা এলাকার নারী ভোটার মর্জিনা বেগম জানান, প্রার্থী যেই হোক না কেন- সৎ, যোগ্য ও মানুষের জন্য যে কাজ করবেন এমন নারী প্রার্থীকেই তারা ভোট দেবেন।

রংপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক চৌধুরী ডিউক যেমন চারদিকে ছুটছেন তেমনি তারপক্ষে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন নারী কর্মী ও সমর্থকরা। বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনটিতে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ ছাড়াও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছে। বদরগঞ্জের গোপীনাথপুরে নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে একদল নারীকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হ্যান্ডবিল বিলি করতে দেখা গেছে। একই চিত্র অন্যান্য আসনগুলোতে প্রার্থীদের পক্ষে নারী কর্মী ছুটছেন ভোটারদের দুয়ারে দুয়ারে। তাদের বিচরণ ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বেশি। নারী কর্মীরা সহজেই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারছেন।

রংপুর-৫ আসনের (মিঠাপুকুর) শঠিবাড়ি এলাকায় কথা হয় জাকির হোসেন সরকারের এক কর্মীর সঙ্গে। রাবেয়া সুলতানা নামের ওই নারী বলেন, ভোটের সময় আমাদেরকে অনেকেই প্রচার-প্রচারণার জন্য ডেকে থাকে। এর জন্য পারিশ্রমিকও দেন। কিন্তু আমাদের তো নিজস্ব ভালো লাগা ও পছন্দের প্রার্থী থাকে, এ কারণে পারিশ্রমিকের দিকে না তাকিয়ে প্রার্থীকে জয়ী করতে আমরা মাঠে কাজ করছি।

একই কথা বলেন বদরগঞ্জের আফরোজা বেগম। তিনি বলেন, আমরা ভালোবাসা থেকে প্রচারণার জন্য এগিয়ে এসেছি। আমাদের কাউকে কাজ করতে বাধ্য করা হয়নি। অনেকেই নিজেদের আগ্রহ থেকে হ্যান্ডবিল বিলি করার পাশাপাশি নির্বাচনী গণসংযোগ ও পথসভাতেও অংশ নিচ্ছে। আমরা কর্মী-সমর্থকরা নারী ভোটারদের খুব কাছাকাছি গিয়ে তাদের সঙ্গে মনখুলে কথা বলছি। এতে নারী ভোটাররাও খুশি।  

সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, একজন পুরুষ কর্মীকে কাজে লাগাতে হলে তাকে কম করে হলেও ৫০০-৮০০ টাকা দিতে হয়। কিন্তু একজন নারী কর্মী পাওয়া যাচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। যদিও পারিশ্রমিকের বিষয়ে প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী পরিচালনা কমিটির লোকজনেরা মুখ খুলছেন না। তবে নাম না প্রকাশের শর্তে অনেকেই জানিয়েছে, পুরুষ কর্মীর চেয়ে নারী কর্মীরা কাজ অনেক কম করেন। পুরুষ কর্মীরা দিনে-রাতে সমানতালে সবখানে যেতে পারেন। সে কারণে তাদের পারিশ্রমিকও বেশি। কাউকে কাজ করতে বাধ্য করা হয় না। যারা আগ্রহ দেখান তাদেরকেই কাজে নেওয়া হয়।

কোথাও কোথাও সরকারি বিভিন্ন সুবিধাভোগী নারীদেরকে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। যাদের অনেকেই তাদের প্রার্থী নির্বাচিত না হলে সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে প্রচারণায় এসেছেন। এদের কেউ কেউ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বিভিন্ন সরকারি সুবিধাভোগী। আবার সরকারি আবাসন প্রকল্পে থাকার সুযোগ পেয়েছেন এমন নারী-পুরুষদেরও দেখা গেছে প্রচারণার কাজে। তবে এসব নিয়ে প্রার্থীদের কাউকে অভিযোগ করতে শোনা যায়নি।

এদিকে নির্বাচন ঘিরে নারীদের উৎসাহ-উদ্দীপনার ইতিবাচক দিক তুলে ধরে টানা তিনবার নির্বাচিত রংপুর সদর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারিসহ তৃণমূল পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে এখন নারীর উপস্থিতি দৃশ্যমান। বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা এখন এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সংসদ নির্বাচনেও অনেক হেভিওয়েট নারী রয়েছে, যারা শুধু তৃণমূলে নয় সমগ্র দেশের মানুষের কাছে আইডল।

জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, রংপুর জেলার ছয়টি আসনে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলে ৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে রংপুর-১ আসনে নয়জন, রংপুর-২ আসনে তিনজন, রংপুর-৩ আসনে ছয়জন, রংপুর-৪ আসনে তিনজন, রংপুর-৫ আসনে আটজন এবং রংপুর-৬ আসনে সাতজন প্রার্থী। তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত চলবে। ভোটগ্রহণ আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি (রোববার) অনুষ্ঠিত হবে। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ