চলমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট পর্যবেক্ষণে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের অনুমতি পেয়েছে তার মধ্যে বরিশাল বিভাগ থেকে সোসাইটি ফর রুরাল নিড (স্রাবন)। কাগজে কলমে বরিশাল উল্লেখ করা হলেও এই প্রতিষ্ঠানটির কোনো কার্যালয় বরিশালে নেই। 

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান অনুমোদনে ব্যবহৃত বরিশাল হাসপাতাল রোডের ঝাউতলা গলির ৩১৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের মেহেদী কমপ্লেক্সের কার্যালয়ে গিয়ে স্রাবনের কোনো কার্যালয় পাওয়া যায়নি।

সোমবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুরে স্রাবন কার্যালয় খুঁজতে গিয়ে ওই ভবনের তৃতীয় তলায় উত্থান নামের একটি অফিস পাওয়া গেছে। সেই প্রতিষ্ঠানে কথা হয় সাকিব আহমেদ বাশারের সঙ্গে। তিনি স্রাবনের প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। উত্থান ও স্রাবন একই ব্যক্তির পরিচালিত উন্নয়ন সংস্থা, বরিশালে স্রাবনের নির্ধারিত কোনো কার্যালয় নেই বলে জানান সাকিব আহমেদ বাশার।

উত্থান নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্রাবনের নির্বাহী পরিচালক আশ্রাফ উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বরিশালে প্রধান কার্যালয় না থাকায় স্রাবনের মূল কার্যক্রম প্রধান কার্যালয় পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার ১১নং দাসপাড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড চর আলগী আশরাফ উদ্দিনের নিজ বাড়িতে পরিচালনা করা হয়।

আশ্রাফ হোসেন বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা ৩শ পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা সরকারের তালিকাভুক্ত নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সংস্থা।

সোসাইটি ফর রুরাল নিড প্রধান নির্বাহী সাকিব আহমেদ বাশার বলেন, ২০০৮ থেকে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সবগুলোতে স্রাবন পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছে। এছাড়া সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে আমরা সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বরিশাল বিভাগের সবগুলো জেলাসহ সিলেটেও আমরা পর্যবেক্ষক দিয়েছিলাম। চলমান দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায় ১৪টি আসনে ১৮২ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছি। এখন নির্বাচন কমিশন কতজনকে অনুমতি দেয় তা তাদের ওপর নির্ভর করে।

এই কর্মকর্তা বলেন, উত্থান এনজিওর তদন্ত চলায় বরিশালের কার্যালয় থেকে স্রাবনের সাইনবোর্ড নামিয়ে রেখেছি।  

বাউফলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্রাবন প্রধান কার্যালয়ের এলাকায়ও উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করেনি। এ কারণে সেখানকার কেউ এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান সর্ম্পকে অবহিত নন। চর আলগীর আশ্রাফ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, একতলা নির্মাণাধীন বাড়ির কলাপসিবল গেটের কাছে ছোট একটি নেমপ্লেট ঝুলানো রয়েছে। এছাড়া স্রাবনের কার্যক্রম তিনি তার নির্মাণাধীন ভবনের শোয়ার ঘরে পরিচালনা করেন।

দাসপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এএনএম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ৯নং ওয়ার্ডের আশ্রাফের স্রাবন নামে একটি এনজিও চালু করেছিল তাও ৪/৫ বছর আগে। এখন সেটির কার্যক্রম পরিচালিত হয় কীনা আমার জানা নেই। তবে ওই সময়ে দেখেছি সে বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি কর্মসূচি পালন করছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, স্রাবন নামে কোনো এনজিও রয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। এছাড়া বরিশালের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এনজিও সমন্বয় সভা হয়। সেখানেও একটি তালিকা রয়েছে। সেই তালিকায়ও সোসাইটি ফর রুরাল নিড (স্রাবন) নামের কোনো নাম নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তর সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে গণহারে এনজিওর অনুমোদন দিয়েছিল। যদি এটি কোনো অনুমোদন পেয়ে থাকে তাহলে ওই সময়ে পেয়েছে। এর কোনো কার্যক্রম নেই। এরা নির্বাচনইতো বোঝে না। তারা নির্বাচনের আরপিও জানে না। নির্বাচন পর্যবেক্ষণতো পরের কথা।

রফিকুল আলম বলেন, নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ের সঙ্গে এই সমস্ত এনজিওর একটি লেনদেনের ব্যাপার থাকে। হয়তো পর্যবেক্ষণ করলো, তারা সেখানে কিছু অর্থ দিলো। এগুলো দেখিয়ে নাম সর্বস্ব এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠান তাদের প্রফাইল ভারি করলো।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (এডাব) এর বরিশাল শাখার সভাপতি কাজী জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমি শুধু এডাব নয় এনজিওগুলোর সমন্বয়কও। কিন্তু আজ পর্যন্ত সোসাইটি ফর রুরাল নিড (স্রাবন) নামের কোনো এনজিও রয়েছে বলে আমার জানা নেই। নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সরকারি কাজতো, কে কোনো জায়গা থেকে নেয় তা জানা নেই। বরিশালের মধ্যে এই নামে কোনো এনজিও থাকলে তা আমার জানা থাকতো।

অভিযোগ আছে আরও
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, শুধু স্রাবন নয় বরিশাল বিভাগে প্রতিষ্ঠিত এমন ৭টি উন্নয়ন সংস্থাকে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবর রহমান সিকদারের সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (সাস), পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মাহবুবুল আলমের সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট অ্যান্ড কো অপারেশন অর্গানাইজেশন (সাকো), গলাচিপা উপজেলার শাহিন মিয়ার সেজুতি হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (সিডফ), ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার এআরএম মামুনের যুব উন্নয়ন সংস্থা, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার মোসা. শাহনাজ খানমের সোস্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিউনিটি অর্গানাইজেশন (সাকো) ও ভোলা সদর উপজেলার কালীবাড়ি রোডের জাকির হোসেন চৌধুরীর অগ্রদূত সংস্থা (এএস)।

এই ছয়টি প্রতিষ্ঠানের তিনটির সাইনবোর্ড ভিত্তিক কার্যালয় পাওয়া গেছে। এরমধ্যে অগ্রদূত সংস্থা, সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা (সাস), সেজুতি হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (সিডফ)। বাকিদের কার্যালয়ে কার্যক্রম পাওয়া যায়নি।

অগ্রদূত সংস্থার প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, এই নির্বাচনে অগ্রদূত সংস্থার পক্ষ থেকে ২৩টি জেলার ৩৯টি আসনে ৩৯১ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। অগ্রদূত সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে এই সংস্থার আওতায় প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি বিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সেজুতি হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (সিডফ) প্রধান নির্বাহী শাহীন মিয়া বলেন, এবারই প্রথম আমরা নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে যুক্ত হলাম। এজন্য পটুয়াখালী জেলার ৪টি সংসদীয় আসনে ৩০ জন পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছি। আমরা জানি না নির্বাচন পর্যবেক্ষকের কার্যক্রম ও ভূমিকা সর্ম্পকে। এ সর্ম্পকে নির্বাচন কমিশনও আমাদের কোনো ধারণা দেয়নি। আমি ভেবেছিলাম কমিশন আমাদের নিয়ে বসবেন এবং সাম্যক ধারণা দিবেন। তা করেনি। তবে নিজেদের আগ্রহে আমরা পর্যবেক্ষক হিসেবে সম্পৃক্ত হয়েছি।

কর্তৃপক্ষ যা মনে করেন
বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচন কমিশন কোনো প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষকের অনুমতি দিলে যদি সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম না থাকে, কার্যালয় না থাকে সেটি দেখার বিষয় নির্বাচন কমিশনের। আমি আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ওই বিষয়ে দেখার এখতিয়ার রাখি না। তাছাড়া কোনো সংস্থাকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করতে সুপারিশ করার এখতিয়ারও আমার নেই।

এই কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অনুমতি পাওয়া পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর সুপারিশ করা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা তদন্ত করে আমরা নিযুক্ত করতে পারি। কারও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পেলে তাকে বাতিল করা হবে।

এমএএস