লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ
৫ হাজার একর জমিতে ৭ হাজার টন ধান উৎপাদন
লবণ পানির কারণে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের শসীখালী বিলের প্রায় ৫ হাজার একর জমি এক সময় অনাবাদি থাকতো। বছরের কিছু সময় বাগদা চাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হতো ওইসব জমির মালিকদের। কিন্তু স্থানীয় জমির মালিক, বর্গা চাষি, জনপ্রতিনিধি ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সম্মিলিত উদ্যোগে লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ করে ধান চাষ করা হয়েছে অনাবাদি এই জমিতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দাবি, চাষের আওতায় আসা ৫ হাজার একর জমিতে প্রায় ৭ হাজার টন ধান উৎপাদন হবে। পাশাপাশি ঘেরের পাড়ে তরমুজ, সিম, শসা, মুলা, কফিসহ বিভিন্ন সবজির বাম্পার ফলন হয়েছে। এতে লাভবান হবেন ৫ শতাধিক কৃষক ও জমির মালিকরা।
বিজ্ঞাপন
তহিদুল ইসলাম নামে কৃষক বলেন, জমিতে লবণ পানি না আসায় চাষিদের বিশাল উপকার হয়েছে। ধান, পেঁয়াজ, রসুন, তরমুজ সবকিছুর খুব ভালো ফলন হয়েছে। তবে আমাদের এই বিলে কোনো বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ফসলে পানি দিতে খুব কষ্ট হয়, মাছ চাষও ব্যহত হয়। যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা থাকতো, সেচের পাশাপাশি ইদুর দমনেও কাজে লাগানো যেত।
স্থানীয় কৃষক মো. সাইদুল মালঙ্গী বলেন, লবণ পানির জন্য আমাদের এই শসীখালীর বিলে এক সময় কিছুই করতে পারতাম না। ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, স্থানীয় মেম্বার, জমির মালিক ও আমরা কৃষকরা মিলে লবণ পানি ঢোকার পথে বাঁধ দিয়েছি। এখানে আর লবণ পানি প্রবেশ করে না। এখন আমরা ধানসহ সবকিছু চাষ করতে পারি।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, এই বিলে এক সময় শুধু বাগদা চিংড়ির চাষ হতো। সাদা মাছের চাষও করা যেত না লবণের জন্য। এখন বাগদার পাশাপাশি সাদা মাছ ও গলদা চিংড়ি চাষ করছি আমরা।
হাওলাদার মো. আব্দুল হাই নামের এক জমির মালিক বলেন, এই বিলে আমার প্রায় ১০০ বিঘা জমি রয়েছে। আগে তেমন কোনো ফসল হতো না। কৃষকদের নিয়ে এবার ফাল্গুন মাস থেকে আমরা লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছি। এ কারণে বিলে আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। চাষিরা অনেক লাভবান হয়েছে।
বিলে ধান চাষের খরচ ও উৎপাদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহীম শেখ নামে এক চাষি বলেন, এই বিলে বেশির ভাগ জমিতেই মাছ চাষ হয়। ঘেরের মধ্যে ধান করতে ব্যয় অনেকটা কম। ৫২ শতকের প্রতি বিঘা জমিতে আমন ধান চাষে ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। এতে ২৫ থেকে ৩০-৩৫ মন ধান পাওয়া যায়। সঙ্গে রয়েছে গরুর খাবার কুটা। সব মিলিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হয় আমাদের। সেই সঙ্গে ঘেরের পারে তরমুজ, পেঁপে, লাউ, মুলা, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি ও ফল উৎপাদন করে অতিরিক্ত আয় করি আমরা।
তরুণ কৃষক শেখ ইমরান বলেন, আমাদের এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে। বিশেষ করে মাছ চাষ।
অনেক কৃষকই আছে যারা ধান চাষ করতে চায়। কিন্তু লবণ পানি প্রবেশের ফলে তারা ধান চাষ করতে পারে না। গত বছর ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক লবণ পানি প্রবেশ বন্ধের ঘোষণার পর অনেক কৃষক তাদের জমিতে ধান চাষ করেছিল। কিন্তু অনাবৃষ্টি এবং শেষ সময়ে অসাধু মাছ চাষিদের কারণে লবণ পানি প্রবেশের ফলে বেশিরভাগ চাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ বছর ধান চাষের পরিমাণ তুলনামূলক কম। তারপরেও অনেক কৃষক তাদের জমিতে ধান রোপন করেছে। আমি নিজেও ৪০ শতক জমিতে ধান চাষ করেছি। সামনে যদি ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাস লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ থাকে তাহলে এ বছর কৃষকরা লাভবান হবে বলে আশাবাদী।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে কৃষিজ উৎপাদন নানাভাবে ব্যহত হচ্ছে। তবে স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকদের সঙ্গে নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছি যাতে লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ করা যায়। শসীখালীর বিলে আমরা সেটা করতে সক্ষম হয়েছি। যার ফলে এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। লবণাক্ততার কারণে যেসব বিল এখনও অনাবাদি রয়েছে সেসব বিলেও এ ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করলে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন এই জনপ্রতিনিধি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ষাটগম্বুজ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জাকির হোসাইন খান বলেন, লবণ পানির প্রবেশ বন্ধ করায় এবার শসীখালীর বিলে প্রায় ৫ হাজার একর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। এতে প্রায় ৭ হাজার টন ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু কিছু চাষি ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু করেছে। ধানের পাশাপাশি সবজিসহ আইল ফসলও চাষ করছেন কৃষকরা। আমরা কৃষকদের পরামর্শও দিয়ে যাচ্ছি।
শেখ আবু তালেব/এমএএস