বছর পাঁচেক আগের কথা। দিনাজপু‌রের চি‌রিরবন্দর উপ‌জেলার কৃ‌ষিশ্রমিক রা‌কিব হাসান (২৮) এক‌দিন সকা‌লে জমিতে কাজ কর‌তে গে‌লে পা‌য়ে কামড় দেয় বিষধর গোমা সাপ ‌(গোখ‌রো)। ব্যথায় কাতর হ‌য়ে প‌ড়লে স্বজনরা দি‌শেহারা হ‌য়ে প‌ড়েন, রা‌কিব‌কে নি‌য়ে যান পার্শ্ববর্তী গ্রা‌মের কা‌শেম হাজীর কা‌ছে। স্থানীয়‌রা তা‌কে ওঝা হি‌সে‌বেই জা‌নেন। সা‌পের বিষ নামা‌তে পা‌রেন কা‌শেম হাজী, লোকজন বিশ্বাসও ক‌রেন।

রা‌কিব হাসান ঢাকা পোস্টকে ব‌লেন, প্রচণ্ড ব্যথায় ছটফট কর‌ছিলাম। কা‌শেম চাচা তার রুমালের কোনো একটা গিঁট লাগিয়ে দি‌য়ে দোয়া পড়ে ফুঁক দি‌লে ধী‌রে ধী‌রে ব্যথা ক‌মে যায়। হাসপাতাল যে‌তে হয়‌নি, সুস্থ হ‌য়ে বা‌ড়ি ফি‌রে‌ছি। এখন অবশ্য মানুষকে আর ওঝা‌দের ওপর ভরসা কর‌তে হয় না। সরকা‌রি হাসপাতা‌লে সা‌পে কাটা রোগী‌দের উন্নত চি‌কিৎসার ব্যবস্থা আছে।

ওঝা কা‌শেম হাজী (৬৮) পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। তার দা‌বি ৩৫ বছর সাপে কাটা রোগীদের চি‌কিৎসা করেছেন তি‌নি। রোগী‌দের ম‌ধ্যে সুস্থ হওয়ার সংখ্যাই বে‌শি। রুমা‌লে গিঁট বেঁধে দোয়া-দরুদ পড়লে রোগী সুস্থ হয়ে উঠে।

ত‌বে কা‌শেম হাজী এখন সা‌পে কাটা রোগী‌দের চি‌কিৎসায় নি‌জের ওপ‌র ভরসা রা‌খেন না। ঢাকা পোস্টকে তি‌নি ব‌লেন, আগের মতো গাছগাছড়া নেই, তন্ত্রম‌ন্ত্রেরও শ‌ক্তি নেই। অবশ্য আগের মতো সাপও দেখ‌তে পাওয়া যায় না। বনজঙ্গলই নেই, সাপ থাক‌বে কোন জায়গায়। এ ছাড়া সেই ওঝা‌গি‌রি এখন আর নেই। মানুষও নানা ধর‌নের ভেজাল খাদ্যগ্রহ‌ণে রোগ প্রতি‌রোধ ক্ষমতা ক‌মি‌য়ে ফে‌লে‌ছে। আর চি‌কিৎসাবিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত। বা‌ড়ির কা‌ছে হাসপাতা‌লেই সাপে কাটা ‌রোগী‌দের আধু‌নিক চি‌কিৎসা পাওয়া যা‌চ্ছে। তাই কাউকে সা‌পে কাট‌লে ওঝা-ক‌বিরা‌জের কা‌ছে না নি‌য়ে দ্রুত সরকারি হাসপাতা‌লে পাঠা‌নো উচিত।

কাশেম হাজীর মামা সা‌পে কাটা রোগী‌দের বিনামূ‌ল্যে চি‌কিৎসা কর‌তেন। তিনি মারা গে‌ছেন। কা‌শেম হাজীর দা‌বি, মামার কা‌ছেই এই চি‌কিৎসা‌বিদ্যা রপ্ত ক‌রে‌ছি‌লেন তিনি। আর মামার মতো তি‌নিও বিনা পয়সায় সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা করে‌ছেন।

ঢাকা পোস্টকে কা‌শেম হাজী বলেন, রোগীদের আমি ঝাড়ফুঁক কম ক‌রি। যাকে সাপে কামড় দেয় তার নামটা আমাকে জানালে আমার সঙ্গে থাকা একটি রুমালে গিঁট দিই, পরে কিছু দোয়া-দরুদ প‌ড়ি। ‌কিছু সময় প‌র রোগী নি‌জেই তার সুস্থতার কথা জানায়। তবে এ ক্ষে‌ত্রে আমার প্রথম শর্ত হলো অন্যকোনো ওঝা বা কবিরাজের কা‌ছে নেওয়ার আগে আমা‌কে জানা‌লে আমি চি‌কিৎসা ক‌রি। আমার আগে অন্যকোনো কবিরাজ বা ওঝাকে জানালে আমি সেই সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা করি না।

অনেক ওঝার কাছে গিয়ে সাপে কাটা রোগী মারা যায় এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ওঝা কিংবা গুণমান সাপুড়ে এখন আর নেই। যারা আছে তারা এখন বেশির ভাগই ধান্দাবাজি করে। অনেকে আছে বিদ্যা শি‌খে‌নি কিন্তু অর্থের জন্য ধান্দাবাজি শি‌খে‌ছে। মানু‌ষের জীবন নি‌য়ে ধান্দাবা‌জি ভীষণ কষ্টদায়ক।

তিনি আরও বলেন, মানু‌ষের জন্য পরামর্শ থাক‌বে ওঝার কাছে না গি‌য়ে সাপে কাটা রোগীদের সরকারি হাসপাতালগুলোতে যেন নিয়ে যাওয়া হয়। সেখা‌নে অ্যান্টিভেনম ও আধুনিক চিকিৎসা আছে। মানুষ‌কে এই বিষ‌য়ে স‌চেতন করা জরুরি। কারণ এখ‌নো গ্রা‌মের মানুষ সা‌পে কাটার কথা শুন‌লেই আগে ওঝার কা‌ছে ছু‌টে যান।

কা‌শেম হাজী ব‌লেন, সি‌নেমার ওঝা আর বাস্তব ওঝার পার্থক্যটা মানুষ‌কে বোঝা‌তে হ‌বে।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ওঝা কাশেম হাজীর ছেলে গোলাম মাওলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বুঝতে পারার পর থেকে দেখে আসছি বাবা সাপে কাটা রোগী ভালো করেন। রোগী যেখানেই থাক শুধু নামটা বাবাকে জানালে বাবা আচুলিতে (রুমাল) গিঁট বেঁধে দোয়া পড়ে সাপে কাটা রোগীকে ভালো করেন। তবে এখন আর ওঝা কিংবা কবিরাজের কাছে না গিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাওয়া ভালো, তাতে সাপে কাটা রোগী নিরাপদ।

দিনাজপুর জেলার সিভিল সার্জন এএইচএম বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অ্যান্টিভেনম এখন জেলার সদর হাসপাতালসহ প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাওয়া যাচ্ছে। সাপে কাটা রোগীদের কোনো ওঝা বা কবিরাজের কাছে না নিয়ে দ্রুত নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে নিয়ে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করলে সুস্থ হয়ে যাবে।

এমজেইউ