রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের জানপুর এলাকায় ক্যানেলের পাড়ের ৩৫ ফুট ভেঙে ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকালে এ ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন কৃষকের জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। 

শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ভেঙে পড়া সেচ ক্যানেলের সংস্কার কাজ শুরু করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। এমনকি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা যাননি বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

জানপুর এলাকার কৃষক আজহার আলীর দেড় একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। তিনি তিস্তা সেচ প্রকল্পের রংপুর ক্যানেলের পশ্চিম পাড়ের অংশের চাষি। আজহার আলী জানান, তিস্তা নদীর মতো সেচ ক্যানেলের অবস্থাও একই। গত এক যুগে অন্তত সাত বার ক্যানেলের পাড় ভেঙেছে। প্রতি বছর কোনো না কোনো কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এবারও সেচ ক্যানেলের পাড় ভেঙে ২০০ একর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে। কম করে হলেও দুই কোটি টাকার বেশি ফসল তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিতে বারবার এমন হচ্ছে। 

শুধু জানপুর এলাকার কৃষক আজহার আলীর নয়, সেখানকার আমজাদ হোসেনের দেড় একর, মোস্তাফিজারের দুই একর জমির আলু ও তামাক ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। তারা জানান, উত্তর মমিনপুর জানপুর মৌজায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের রংপুর ক্যানেলের পশ্চিম অংশের পাড় ভেঙে ২০০ একর ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে বাঁধটি ভেঙে তলিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্নের আলু, তামাক ও ভুট্টার ক্ষেত।

কৃষক আমজাদ আলী দেড় একর জমিতে তামাক চাষ করেছিলেন। পরিপক্ব তামাক পাতায় ভরপুর ছিল ক্ষেত। তারও জমিতে এখন বালুর স্তুপ। আমজাদ আলী বলেন, ‘তামাকোত বেশি লাভ। সেই জন্তে (সেজন্য) কোম্পানির কাছোত (কাছ থেকে) আগাম টাকা নিয়ে তামাক লাগাইছিনু। জমিত আর তামাকগাছ নাই। সউগ পানিত ভাঙি চলি গেইচে। জমিত বালু পড়ি গেইচে। এ্যালা নতুন করি যে আবাদ করমো সেই অবস্থাও নাই। ক্ষতিপূরণ না পাইলে কেমন করি চলমো সেই চিন্তাই করতেছি হামরা।’

কৃষক মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘মোর আলু আর তামাকক্ষেত নষ্ট হয়া গেইছে। এইবার ক্ষতিপূরণ না পাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকেরা কোনো কাম করবার পাবার নায়। যদি পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকমতো ক্যানেলের কাম করিল হয়, তাইলে হামার এত বড় ক্ষতি হইল না হয়। হামরা সারা বছর কষ্ট করি, আর সরকারের লোকেরা হামার কষ্ট বোঝে না।’

কৃষকদের অভিযোগ, তাদের দুই কোটি টাকারও বেশি ফসলের ক্ষতি হয়েছে। পানির স্রোতের কারণে জানপুর গ্রামে ত্রাণের টাকায় খারুভাঁজ নদীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া একটি খালের ওপর নির্মিত ব্রিজে ফাটল দেখা দিয়েছে। পানির তীব্র স্রোতে বেশ কিছু বাঁশঝাড়, গাছপালা ভেঙে গেছে। এ ছাড়া সেচ ক্যানেলের পানির সঙ্গে বালু জমে চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে জমিগুলো। বিগত সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা ক্ষতিপূরণ না পেলেও এবার তারা অনঢ় অবস্থানে রয়েছেন। ক্ষতিপূরণ না পেলে তারা ভেঙে যাওয়া পাড় মেরামত করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।  

স্থানীয়রা জানান, উত্তর মমিনপুর জানপুর মৌজায় তিস্তা সেচ প্রকল্পের রংপুর ক্যানেলের পশ্চিম অংশের পাড় এক যুগে সাত বার ভেঙেছে। ওই এলাকায় সেচ ক্যানেলটি ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যাওয়ায় পানির বেশি চাপ সৃষ্টি হয় এবং সেচ ক্যানেলের সংস্কারকাজ চলাকালে হঠাৎ করে বেশি পানি ছাড়া হলে পানির চাপে সেই অংশ ভেঙে যায়। এতে প্রায় ২০০ একরের ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। বাঁধটি ভেঙে  কৃষকের আলু, তামাক, ধান, ভুট্টাসহ শাকসবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এখন অনেক অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের দিশেহারা অবস্থা।

মমিনপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আহসান হাবীব দুলাল বলেন, ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও এখন পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কেউ এই এলাকা পরিদর্শনে আসেনি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা সবাই চাষাবাদের ওপর নির্ভরশীল। এই মৌসুমে তারা ধান, তামাক, আলু, ভুট্টার আবাদ করেছে। একে একে গত ১২ বছরে সাত বার ক্যানেলের পাড় ভেঙে গেল। বারবার সেচ ক্যানেলের পাড় ভেঙে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, অথচ এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ড নিম্নমানের কাজ করায় এই ধরনের ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন এই জনপ্রতিনিধি। তিনি আরও বলেন, এবার এলাকাবাসী একজোট হয়েছে- পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস না দিলে তারা সংস্কার কাজ করতে দেবে না। 

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দাবি- ইঁদুরের গর্তের ভেতর দিয়ে পানি বের হতে হতে বড় আকার ধারণ করে পাড়টি ভেঙে গেছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ক্যানেলের পাড়টি পুরোনো হওয়ায় ৩০ থেকে ৩৫ ফুট ভেঙে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইঁদুরের গর্ত থেকে ভাঙনের সূত্রপাত হয়েছে। এতে কিছু জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আমরা ক্যানেলের বাঁধ সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করছি। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর