মিলছে না চিকিৎসা, ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা
বেশির ভাগ রোগী ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরছেন
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় চলমান লকডাউন পরিস্থিতিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। বেশির ভাগ রোগী ঠিকমতো চিকিৎসাসেবা না পাওয়ায় হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরছেন। আবার কেউ হাসপাতাল ছাড়ছেন করোনা আতঙ্কে। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই হাসপাতালে নামছে ভুতুড়ে পরিবেশ। অথচ এক মাস আগেও হাসপাতালে একটি সিট পেতে ধরনা দিতে হয়েছে দিনের পর দিন। কিন্তু এখন অধিকাংশ ওয়ার্ড ফাঁকা।
মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রমেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। অথচ করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের আগে হাসপাতালে সবসময় বিভিন্ন ওয়ার্ড ও মেঝেতে শয্যাশায়ী রোগীদের দেখা গিয়েছিল। রোগী আর স্বজনদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। এখন বেশির ভাগ ওয়ার্ড ফাঁকা।
বিজ্ঞাপন
সকালে হাসপাতালে ঢুকতেই চোখে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে এক রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন তার স্বজনরা। একটু কাছে গিয়ে রোগীর সুস্থতার কথা জানতে চাইলে চিকিৎসাসেবা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জীবন মিয়া। চারদিন আগে তার বৃদ্ধ বাবা আহাদ আলীকে অসুস্থ অবস্থায় লালমনিরহাট সদরের তিস্তা মোস্তফি থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।
ঢাকা পোস্টকে জীবন মিয়া বলেন, হাসপাতালে যদি ঠিকমতো চিকিৎসা না পাই। রোগীর যদি কোনো উন্নতি না হয়, তাহলে হাসপাতালে থেকে কী লাভ? এখানে নামমাত্র চিকিৎসা চলছে।
বেশির ভাগ ওষুধ বাইর থেকে কিনতে হয়। করোনার কারণে চিকিৎসকরা ঠিকমতো রোগী দেখছেন না। বড় চিকিৎসকরা হাসপাতালে নেই। নার্স ও ইন্টার্ন চিকিৎসকরা করোনা আতঙ্কে রোগী দেখেন না।
বিজ্ঞাপন
হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে রোগীকে ভর্তি করিয়েছেন লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার এলাকার নিয়াজ আহমেদ।
তিনি বলেন, দালালের কারণে হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসার খরচ বেশি। কথায় কথায় বিভিন্ন পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। সবই কিছু হাসপাতালের বাইর থেকে করা লাগে। এখানে প্রয়োজনের সময়ে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই। মানুষ সরকারি হাসপাতালে তাহলে কেন আসবে?
হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা গেছে, নিত্যদিনের ভিড় নেই। কমে গেছে রোগী। অধিকাংশ ওয়ার্ড ফাঁকা। অথচ ১০০০ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালে সবসময়ই দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকতেন। কিন্তু সম্প্রতি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর রোগীর সংখ্যা কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে শুধু গুরুতর অসুস্থ রোগী হাসপাতালে আসায় চাপ অনেক কমে গেছে। মূলত করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং কঠোর লকডাউন পরিস্থিতিতে দুর্ভোগের আশঙ্কা থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন রোগীদের হাসপাতালে আসা কমে গেছে। এছাড়া করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে আগের মতো রোগীর সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের ভিড় নেই।
রোগীর স্বজনরা জানান, হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের রোগী আসছে। কেউ চিকিৎসা পাচ্ছেন, আবার কেউ কেউ ঠিকমতো সেবা পাচ্ছেন না। রোগী ও চিকিৎসক সবার মধ্যে করোনা ভীতি রয়েছে। করোনা আতঙ্কে কেউ কেউ হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই চিকিৎসাসেবা না পেয়ে বাধ্য হয়েই হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
নীলফামারীর ডিমলা থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন বিউটি বেগম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত পরশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। এখানে চিকিৎসাব্যবস্থা এতটাই খারাপ, আগে জানলে বাসায় থাকতাম। ঠিকমতো চিকিৎসক খোঁজখবর নিচ্ছেন না। মাঝেমধ্যে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা আসছেন। কিন্তু তারা ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি চলে যেতে উৎসাহিত করছেন।
মেডিসিন বিভাগের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের রোগী সালামের স্ত্রী মিনারা বেগম বলেন, বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) রাতে হঠাৎ অসুস্থ হন আমার স্বামী। পরে কালিগঞ্জ হাসপাতালে ভর্তি করালে সেখানে তার শরীরের অবনতি হলে রংপুরে নিয়ে আসি। কিন্তু এখানে আসার পর চিকিৎসাব্যবস্থার বেহাল দশায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছি। রোগীর জ্ঞান ফেরেনি, সেই রোগীকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু উপায় না পেয়ে হাতেপায়ে ধরে এখনো হাসপাতালে রয়েছি।
হাসপাতালের নিউরোলজি, হেমাটোলজি, ফিজিক্যাল মেডিসিন, লিভার হেপাটোলজি, চর্ম ও যৌন রোগ, মানসিক এবং রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের রোগীদের জন্য ৭ নম্বর ওয়ার্ড নির্ধারিত। ৩৯ বেডের বিপরীতে বর্তমানে রোগী কয়েকজন। একই অবস্থা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ও নেফ্রোলজি (কিডনি) ওয়ার্ডসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের।
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের স্টাফ নার্স এবং ওয়ার্ড ইনচার্জরা জানান, রোগীদের সঙ্গে আমরাও করোনা আতঙ্কে রয়েছি। কারণ সেবিকারও ঠিকমতো নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। কঠোর বিধিনিষেধের কারণে রোগীর চাপ কমেছে। যেখানে সবসময় দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকত। চিকিৎসা দিতে হিমশিম লেগে যেত। এখন রোগী অনেক কম। গত বছরও করোনা মহামারির শুরুর দিকে এমন অবস্থা হয়েছিল।
চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন এ অভিযোগ মানতে নারাজ রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. রেজাউল হক।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এমন অভিযোগ তো কেউ করেনি। তবে করোনার সংক্রমণ ঝুঁকিরোধে চিকিৎসক ও ইন্টার্নরা সমন্বয় করে কাজ করছেন। একসঙ্গে তাদের সবাই হাসপাতালে উপস্থিত থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া বিধিনিষেধের কারণে আগের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ রোগীরা হাসাপাতালে ভর্তি হচ্ছেন না। এ কারণে রোগীর চাপ কম।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএম