বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ যে চেয়ারটিতে বসে লিখেছেন তার প্রিয়তম লেখাগুলো—সেই চেয়ারটির সন্ধান পাওয়া গেছে। ৭৭ বছর আগে জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ত্যাগ করার পর তার জন্মভিটাও বেহাত হয়ে যায়। শেষ স্মৃতি বলতে কিছুই ছিল না। তাই তার চেয়ারটি বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

ঢাকা পোস্টকে এমনটাই জানিয়েছেন বাংলা একাডেমি ২০২৪ পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক তপংকর চক্রবর্তী। তিনি জানান, চেয়ারটি ৫১ বছর ধরে তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। একবার চেয়ারটি লুট হয়ে গিয়েছিল। পরে খোঁজ পাওয়ায় ৩০ টাকায় পুনরায় কিনে এনে বাসায় রেখেছেন তিনি। যদিও চেয়ারটি চক্রবর্তী পরিবারে এসেছে ৭৫ বছর আগেই।

তপংকর চক্রবর্তী বলেন, আমাদের পরিবারের সঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের পরিবারের গভীর সখ্যতা ছিল। আমার বাবা শৈলশ্বর চক্রবর্তী ছিলেন যুগান্তর বিপ্লবী দল ও তরুণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক। পরে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং বরিশালের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯০৩ সালে জীবনানন্দের জ্যাঠা (চাচা) হরিচরণ দাশগুপ্ত বগুড়া রোডে জায়গা কিনে ভিটে করেন। আমাদের জানা মতে ওখানে ৫ থেকে ৬ বিঘা জমি ছিল। সেই জমিতে জীবনান্দের পিতামহ সরবানন্দ দাশগুপ্ত একটি খড়ের বাড়ি করেন। বাড়ির নাম দেন সাধনকুটির। এখানেই তিনি থাকতেন। পরে সাধনকুটিরের নাম সর্বানন্দ ভবন করা হয়। সেখানেই জীবনানন্দের পুরো পরিবার থাকত।

তিনি আরও বলেন, জীবনান্দের পিসি স্নেহলতা দাশ বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালেয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। যদিও ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তিনিও বরিশাল ত্যাগ করেন। স্নেহলতা দাশ বরিশাল ত্যাগ করার দুই বছর আগে ১৯৪৮ সালে আমার বাবাকে জীবনানন্দ যে চেয়ারটিতে বসে লিখতেন সেটি দিয়ে দেন উল্লেখ করে পিতার বক্তব্যের বরাত দিয়ে তপংকর চক্রবর্তী বলেন, স্নেহলতা বাবাকে বলেন মিলু (জীবনানন্দ দাশ) এই চেয়ারে লেখালেখি করতো। ওতো দেশে নেই, চেয়ারটি খালি পড়ে আছে। আমার খুব খারাপ লাগছে। তুমি (শৈলশ্বর চক্রবর্তী) এই চেয়ারটি নিয়ে যাও।

পরিবারের সাথে জীবনানন্দ দাশ

বাবা চেয়ারটি আমাদের বাসায় নিয়ে আসেন। চেয়ারটি সেগুন কাঠের ও কালো রং করা ছিল। ভিতরে লোহাও নড়বড়ে হয়ে ছিল। পরে আমরা মিস্ত্রী দিয়ে শক্ত করি ও চেয়ারটিতে লাল রঙের বার্নিশ করি।

তপংকর চক্রবর্তী জানান, ১৯৭১ সালে আমাদের বাড়ি লুট হলে চেয়ারটিও লুট করে নিয়ে যায়। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৭২ বাজার রোডে চেয়ারটির সন্ধান পাই। চেয়ারটি বানানো হয়েছে আলাদাভাবেই। ফলে দেখলেই সহজে শনাক্ত করা যায়। আমি যে দোকানে দেখি তার কাছে চেয়ার কোথা থেকে পেয়েছে জানতে চাইলে দোকানি জানান, কুঁড়ি টাকায় তিনি কিনে রেখেছেন। পরে আমি সেই দোকানির কাছ থেকে ৩০ টাকায় চেয়ারটি কিনে এনে বাসায় রেখেছে। সেই থেকে চেয়ারটি আমাদের কাউনিয়া ব্রাঞ্চ রোডের বাড়িতে রয়েছে।

তিনি বলেন, চেয়ারটি একটি ইতিহাস। আমি চাই জীবনানন্দের কোন স্মৃতিশালা বা ইনস্টিটিউট হলে সেখানে চেয়ারটি দিতে। কিন্তু তেমন কোন প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় দিতে পারছি না।

উল্লেখ্য, কবি জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের আজকের দিনে (১৭ ফেব্রুয়ারি) বরিশালের জন্মগ্রহন করেন। আজ তার ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। দিবসটি উদযাপনে সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকলেও বিভিন্ন আয়োজনে স্মরণ করা হচ্ছে জীবনানন্দ দাশকে। সকাল ৯টায় জাতীয় কবিতা পরিষদ জীবনানন্দ দাশের জন্মভিটায় অবস্থিত মিলনায়তনে শ্রদ্ধা নিবেদন পুরস্কার বিতরণী, আলোচনা সভা ও কবিতা পাঠের আয়োজন করেছে। সকাল ১০টায় সরকারি ব্রজমোহন কলেজে উদ্বোধন হবে সাংস্কৃতিক সংগঠন উত্তরণ আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী জীবনানন্দ মেলার। একই সময়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বাংলা বিভাগ। আজ সন্ধ্যা ৬টায় ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে জীবনানন্দ দাশের লেখা গান পরিবেশনের আয়োজন করেছে জীবনানন্দ জন্মজয়ন্তী উদযাপন পর্ষদ। জীবনানন্দ দাশের লেখা কবিতায় সুর করে আগে গান হিসেবে পরিবেশিত হলেও এবারই প্রথম তার লেখা গানে সুর দেওয়া হয়েছে। গান সংগ্রহ করেছেন প্রখ্যাত জীবনানন্দ গবেষক আমীন আল রশীদ। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরকে