নাতিকে হারিয়ে আহাজারি করছেন বৃদ্ধা মমতা বেগম (ইনসেটে মোক্তার হোসেন গাজী)

‘দুপুরে ভাইরে আমি মুরগির মাংস, শাক, ডাল ও দুধ দিয়ে ভাত খাইয়েছিলাম। খেয়ে কাউকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আমার ভাই। আমরা জানতাম, ভাই আমার মোটরসাইকেল চালাতে গেছে। সেই যে গেল, এরপর আর আমার ভাই ফিরে আসেনি। আমাকে নানি বলে ডাকেনি।’

নাতিকে হারিয়ে দুই দিন পরও এভাবেই আহাজারি করছেন পদ্মা নদীতে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো কিশোর মোক্তারের নানি বৃদ্ধা মমতা বেগম।

সোমবার (১১ মার্চ) দুপুরে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার সখিপুর থানার উত্তর তারবুনিয়া ইউনিয়নের মোল্লা কান্দি গ্রামে মোক্তারের নানাবাড়ি গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।

নিহত মোক্তার হোসেন গাজী (১৬) মোল্লা কান্দি গ্রামের বাচ্চু গাজীর ছেলে। তার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, জন্মের পর মোক্তার যখন পা ফেলতে শিখছে, তখনই পারিবারিক কলহে তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর দুঃখ-কষ্টকে সঙ্গী করে বৃদ্ধ নানা-নানির কাছে বড় হয়েছে সে। ছোটবেলা থেকেই একটি চায়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ করত মোক্তার। কিছুদিন আগে তার মামারা তাকে একটি মোটরসাইকেল কিনে দেন। এরপর চায়ের দোকান ছেড়ে ওই মোটরসাইকেলযোগে ভাড়ায় যাত্রীসেবা দিয়ে সে উপার্জন করত। একটু সুখের আশায় ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের আদর ও স্নেহবঞ্চিত মোক্তারকে বিদেশে পাঠানোর চিন্তা করেছিল তার স্বজনরা। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন স্পিডবোট দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে গেছে।

গত শনিবার (৯ মার্চ) কাঁচিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন ছিল। ইউনিয়নটির একাংশ পদ্মা নদীর ওপারে হওয়ায় ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নদীর ওপারে আনা-নেওয়ার জন্য বারেক প্রধানিয়া নামের এক স্পিডবোট চালকের সঙ্গে চুক্তি করে। নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে কাঁচিকাটা প্রান্ত থেকে ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা বারেক প্রধানিয়ার স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দেন। অন্যদিকে কাঁচিকাটা থেকে নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত আরও যাত্রী আনার জন্য বারেক প্রধানিয়ার ছেলে সাইফুল প্রধানিয়া আরেকটি স্পিডবোটযোগে মোক্তার গাজীকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যান বাজার স্টেশন থেকে কাঁচিকাটা রওনা করেন। এরপর স্পিডবোট দুইটি দুলারচর এলাকার মনাই হাওলাদারকান্দি ঘাটের কাছাকাছি পৌঁছালে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে গুরুতর আহত ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের স্থানীয়রা শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। অন্যদিকে অবস্থা গুরুতর হওয়ায় মোক্তার গাজীকে নিকটস্থ চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মোক্তার গাজীর মৃত্যু সংবাদ তার পরিবার পাওয়ার পরে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন তার নানি মমতা বেগম।

প্রতিবেশী কাশেম গাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোক্তার সম্পর্কে আমার নাতি হয়। প্রায় সময়ই আমাদের বাড়িতে আসত সে। আদর করলে আমাকে জড়িয়ে ধরত। খুব ভালো ছেলে ছিল মোক্তার। নানিবাড়ি থেকেই সে বড় হয়েছে। নানিই তাকে লালনপালন করেছে।

মোক্তারের মামি নূর জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলের মতোই বড় করেছি আমরা মোক্তারকে। সকালে আমার ছেলেকে নিয়ে পুরো চর ঘুরে এসেছে। মামা তোকে খুঁজবে এই কথা বলার পরও সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমরা ফেসবুকে খবর পেয়েছি মোক্তার মারা গেছে। মোক্তারের মৃত্যুতে আমি আমার একটি সন্তান হারালাম।

মোক্তারের মামা বাদল মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে নিজের ছেলের মতো করে লালনপালন করেছি। কিশোর বয়স এখনো পেরোয়নি আমার ভাগনের। এই বয়সে মোক্তারকে আমাদের হারাতে হয়েছে। এই কষ্ট কেমনে মেনে নেব! মামলার বিষয়ে বড়দের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’

নাতি হারিয়ে শোকে কাতর নানি মমতা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার ভাইকে আমি কত আদর করতাম। আমি ভাইকে মুরগির মাংস, দুধ দিয়ে ভাত খাওয়াইলাম। খেয়ে বাড়ি থেকে গেল, আর ফিরে এলো না আমার ভাই। আমার ভাইকে আইনা দেন। আমার ভাই কই!’

ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভাবের কারণে শিশু বয়সেই মোক্তারকে স্থানীয় একটি চায়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ করতে হয়েছে। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে ভাড়ায় মোটরসাইকেলযোগে যাত্রী আনা নেওয়া করত। তার মৃত্যুতে উপজেলা প্রশাসন শোকাহত।

সখিপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা নদীতে স্পিডবোট দুর্ঘটনার বিষয়ে এখনো কোনো মামলা হয়নি। নিহত কিশোরের পরিবার মামলা করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সাইফ রুদাদ/এমজেইউ