ধ্বংসস্তূপে ৭২ ঘণ্টা চাপা পড়েছিল শিল্পী
রানা প্লাজায় হাত হারানো শিল্পী
‘সেই দিনের কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে। মনে হয় যেন সবকিছু ভেঙে গায়ে পড়ছে। ঘুমের মধ্যে প্রায়ই চিৎকার করে উঠি। ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে অন্ধকারে তিন রাত, তিন দিন চাপা পড়েছিলাম। বের হওয়ার সুযোগ ও সামর্থ্য কোনটাই ছিল না। চিৎকার দিলেও কেউ শোনেনি। ক্ষুধা আর চাপা পড়া হাতের যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করেছি।’
২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে হাত হারানো পোশাক কারখানার শ্রমিক শিল্পী বেগম এভাবেই তুলে ধরেন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতিগুলো। রানা প্লাজা ধসের ৮ বছর পার হলেও এখনও দুঃসহ সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি তিনি। সেই স্মৃতি এখনও তাড়া করে বেড়ায় তাকে।
বিজ্ঞাপন
শিল্পী গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ফুকরা ইউনিয়নের তারাইল উত্তরপাড়া গ্রামের ওহিদ বিশ্বাসের স্ত্রী। বিয়ের পর স্বামীর সংসার চালাতে কষ্ট হতো। স্বামী-সন্তান ও ননদ লতা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় যান। কিছু দিন পরে সাড়ে ৩ হাজার টাকা বেতনে সাভারের রানা প্লাজার পঞ্চম তলার ফ্যান্টম ট্যাক লিমিটেড পোশাক কারখানায় ফিনিশিং হেলপার হিসেবে কাজ নেন।
দুর্ঘটনার ৬ মাস আগে তিনি ওই পোশাক কারখানায় যোগ দিয়েছিলেন। ভবন ধসের আগের দিন তার স্বামী অসুস্থ থাকার কারণে কাজে যেতে পারেননি। প্রতি মাসের ২৪ তারিখে ওভারটাইমের বেতন শিট তৈরি করা হয়। তাই সকলের মতো শিল্পীও সেদিন অসুস্থ স্বামীকে বাসায় রেখে হাজিরা দিতে কাজে গিয়েছিলেন। কিন্তু সব কিছুই যেন কেমন হয়ে গেল। শিল্পী বেগম বেঁচে গেলেও ননদ লতা বেগমের লাশের সন্ধান মেলেনি।
বিজ্ঞাপন
সেই দুঃসহ দিনের কথা মনে করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিল্পী বেগম বলেন, অন্যান্য দিনের মতো সেদিন অফিসে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। বিকট শব্দ শুনতে পাই। কিছুক্ষণ পর ঝাঁকুনি দিয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়ে ভবন। আস্তে আস্তে হাতের ওপর অনুভব করি ভারী কোন বস্তুর উপস্থিতি। ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসে নিঃশ্বাস। কয়েক ঘণ্টা পর চাপা পড়া হাতে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকি। অন্ধকারে চারিদিকে শোনা যায় শুধু মানুষের বাঁচার আকুতি।
তিনি আরও বলেন, দুই দিন পর নাকে পঁচা লাশের দুর্গন্ধ আসে। এভাবে বিনা খাবারে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ৭২ ঘণ্টা চাপা পড়েছিলাম। ডান হাত মেশিনের নিচে পড়ে থেতলে যায়। তিন দিন পর উদ্ধার কর্মীরা কাছে গিয়ে বলেন, হাত কেটে বের করতে হবে। প্রথমে আমি রাজি না হলেও পরে রাজি হই। তিন দিন পর আমাকে উদ্ধার করে সাভার সেনানিবাস হাসপাতালে ভর্তি করেন উদ্ধারকর্মীরা।
সরেজমিনে শিল্পী বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ডান হাত হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। এক হাত দিয়েই রান্না-বান্নাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ করছেন। এখনও তার শরীরে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। নিয়মিত খেতে হয় ওষুধ। সরকারের পক্ষ থেকে শিল্পীকে এক কালীন ১০ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকার মতো পান। অসুস্থ স্বামী বাড়ির পাশে একটি মুদি দোকান নিয়ে বসেছেন। তা দিয়েই কোনমতে চলছে শিল্পীর সংসার ও তিন ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া এবং নিজের ওষুধ কেনা।
শিল্পী বেগমের স্বামী ওহিদ বিশ্বাস (৪৫) বলেন, আমি খুব অসুস্থ। শ্বাসকষ্টের সমস্যার কারণে কোন কাজ করতে পারি না। তারপর ছেলে মেয়ের লেখাপড়া এবং ঘরে অসুস্থ মা রয়েছে। সব মিলিয়ে কষ্টে চলতে হয়। এ ছাড়া আমার স্ত্রী মাথা ও বুকে মারাত্মক আঘাত পেয়েছিল। ব্যথার জন্য এখনও প্রতি মাসে অনেক টাকার ওষুধ কিনতে হয়।
এসপি