ফুটপাতে গণইফতারের আয়োজন তরুণ শিক্ষার্থীদের
ইফতারে ১৫ মিনিট বাকি থাকতে যাত্রী নামিয়ে সড়ক ও জনপদ কার্যালয়ের সামনে হাজির রিকশা চালক তৌহিদ। সড়কের পাশে রিকশা রেখে ফুটপাতে বিছানো চটে ইফতার করতে বসে পড়লেন তিনি। কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই আরও অনেকেই চলে এসেছেন ইফতার করতে। কেউ রিকশা, কেউ ভ্যান, কেউ অটোরিকশা আবার কেউ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক ফুটপাতের পাশে রাখছেন। কেউ মোটরসাইকেল, কেউবা বাইসাইকেলে রেখে এক কাতারে লম্বা সারিতে বসে পড়ছেন।
মাগরিবের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই রোজাদার মুসল্লিদের সংখ্যাও বাড়ছে। মুহূর্তের মধ্যেই শতাধিক মুসল্লির বেশি রোজাদার সারিতে বসেছেন। অন্যদিকে তরুণ কলেজশিক্ষার্থীরা ইফতার প্রস্তুত করে থালায় করে উপস্থিত মুসল্লিদের সামনে পরিবেশন করছেন। কেউ ছোলা, বেগুনি আবার কেউ খেজুর কলাসহ মুড়ি দিচ্ছেন। এক সারিতে ধনী-গরিব, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষের এক অন্যান্য মেলবন্ধন ঘটেছে। ইফতারে আগ মুহূর্তে এমন ভ্রাতৃত্বময় দৃশ্য ফুটে উঠেছে ফুটপাতের ‘একসাথে ইফতারে’।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) মানিকগঞ্জ জেলা শহরের সড়ক ও জনপদ কার্যালয়ের সামনের আয়োজন করা হয় এ ইফতারের। তিন বছর ধরে পবিত্র মাহে রমজানে বিনামূল্যে এই ইফতারের আয়োজন করে আসছে ‘লাইফ ফর ব্লাড’ নামে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ধনী-গরিব, রিকশাচালক, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী থেকে চাকরিজীবী, ছিন্নমূল মানুষসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ শামিল হন এই ইফতারে।
সদর উপজেলার সেওতা এলাকার বাসিন্দা আবদুল হালিম। ছেলে সন্তান থাকলেও সংসারের খরচ মেটাতে জেলা শহরে রিকশা চালান তিনি। ইফতারের আগ মুহূর্তে আলাপ হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্যাডেলে রিকশা চালিয়ে সারাদিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কামাই (উপার্জন) করি। এখন জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে পরিবার নিয়ে ইফতার করতে গেলে ২৫০ টাকার বেশি ইফতারির পণ্য কিনতে হয়। এ কারণে এখানে প্রায়ই ইফতার করি, এতে আমার অনেক উপকার হয়। আর ইফতারটাও ভালো খাইতে পারি।
বিজ্ঞাপন
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে গ্রামের বাড়ি হলেও মানিকগঞ্জের দীর্ঘদিন ধরে রিকশা চালান রেজাউল। তিনি বলেন, বেউথা এলাকায় মেসে ভাড়া থাকি, দিনভর রিকশা চালিয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা কামাই করতে পারি। নিজের খরচ বাদে সব টাকা পরিবারের জন্য পাঠাই দেই। এইখানে এসে ইফতারি করি, এতে আমার কম হলে ৫০ টাকা বাঁচে, আর ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে এখানে ইফতার করে। এটি আমার কাছে অনেক ভালো লাগে, গত বছরও এখানেই ইফতার করছিলাম।
সদর উপজেলার পাঁছ বারইল গ্রামের রিকশা চালক তৌহিদ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহরে রিকশা চালিয়ে যা কামাই করি তা দিয়ে সংসার চালানোই অনেক কষ্ট। বাজারে গেলেই বোঝা যায় গরিবের কষ্ট কী? রোজার মাসে এখানে এসে ইফতার করি। আমাদের মতো খেটে খাওয়া অনেক মানুষই এখানে ইফতার করতে আসে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘লাভ ফর ব্লাড’ এর সদস্য নিবিড় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের শহরে লোকজন ইফতার সময়ে বাসায় গিয়ে ইফতার করতে পারে। কিন্তু শহরের রোজগার করতে আসা দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালকসহ খেটে খাওয়া মানুষগুলো ইফতারের সময় তাদের বাড়ি যেতে পারে না। তাদের জন্যই আমাদের এই আয়োজন। এখানে ধনী-গরিবসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ একসারিতে বসে ইফতার করতে পারে। ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম বলে একসাথে ইফতার করতে পারছি।
প্রতিদিন ১২০ থেক ১৫০ জন আবার কোনোদিন ২০০ জন মানুষ এখানে ইফতারি করতে পারেন। এতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা খরচ হয়। সংগঠনের সদস্য, এলাকার বড় ভাই এবং পারিবারিকভাবে সহযোগিতা নিয়ে এ ইফতারের খরচের জোগান দিচ্ছেন সংগঠনের সদস্যরা। ২০২২ সালে সাত দিনে জন্য এই ইফতারির আয়োজন করে সংগঠনটি। পরের বছর ২০২৩ সালে ১৫ দিন আর এ বছর রমজানের পুরো মাস জুড়েই ছিন্নমূল এসব মানুষদের ইফতারি করানোর পরিকল্পনা রয়েছে সংগঠনের তরুণ এই উদ্যোক্তাদের।
সোহেল হোসেন/এএএ