মরিয়ম খাতুন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিকিট কালেক্টর পদে কাজ করেন। আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তাকে এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত ২১ মাস ধরে তিনি কোনো বেতন পাননি। এরমধ্যে সম্প্রতি জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে তাদের কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। এ নোটিশ পেয়ে মরিয়মের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে।  

তার মতো এমন অবস্থা বগুড়ার আট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মোট ৩২ জন সেবাপ্রদানকারীর। বিষয়টির সুরাহা পেতে তারা দরখাস্ত নিয়ে বগুড়া সিভিল সার্জন অফিসে অবস্থান নেন। কিন্তু জেলা স্বাস্থ্যবিভাগও নিজেদের কোনো দায় নেই বলে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

জানতে চাইলে মরিয়ম খাতুন বলেন, আমি তিন বছর যাবত শিবগঞ্জ হাসপাতালে  টিকিট কালেক্টর হিসেবে কাজ করেছি। এই যে একটা ঈদ যাচ্ছে, আমরা কিছুই কিনতে পারছি না বাবা-মায়ের জন্য। তারপর ঈদের আগে বোনাস চাইছি, তখন জানতে পারলাম আমাদের নাকি চাকরি নাই ১০ মাস আগে। আমরা এখন কী করব বলেন, আমাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ১০ মাস বেশি কাজ করে নেওয়ার পরেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।

আদমদীঘি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাবুর্চী হিসেবে কাজ করে আসছেন আদরী বেগম। তিনি বলেন, আমিও ২১ মাস ধরে বেতন পাই না। আমার একটা ছোট বাচ্চা আছে। খুব কান্না করছে। সামনে ঈদ কোনো কাপড় দিতে পারছি না।

কাজের সম্পর্কে আদরী বেগম বলেন, আমি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কাজ করি। আমি একটা মেয়ে হয়ে রান্না বাবুর্চির কাজ করি, খাবার পরিবেশন করি। শুধু মাস গেলে বেতন পাই না।  

চুক্তিভিত্তিক এই সেবাপ্রদানকারীদের কাছে থেকে জানা যায়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মেসার্স সারমী ট্রেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলাম বগুড়া জেলার ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩২ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী নিয়োগের ঠিকাদারি পায়। পরবর্তীতে তাদের ওই কার্যক্রমের মেয়াদ প্রতিবছর বৃদ্ধি হয়ে আসছে।

এসব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকিট কালেক্টর, বাবুর্চি পদে সেবা ক্রয় করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে টিকিট কালেক্টরের বেতন প্রতিমাস ১৭ হাজার ৬৩০ টাকা। আর বাবুর্চিদের বেতন ১৬ হাজার ১৩০ টাকা করে নির্ধারণ করা আছে।

তবে ২০২১-২০২২ পর্যন্ত এই ৩২ সেবাপ্রদানকারী কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পেয়ে এসেছেন। কিন্তু এর পর থেকে তাদের বেতন অজ্ঞাত কারণে আটকে যায়। এই বেতনও কাউকে সঠিকভাবে প্রদান করা হতো না বলে অভিযোগ করেছেন এই কর্মচারীরা। প্রতি মাসের বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে তাদের দেওয়া হতো। যদিও তারা পূর্ণ বেতন পেয়েছেন মর্মে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হতেন।

বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বেতন ১৬ হাজার ১৩০ টাকা। কিন্তু আমি কখনও ওই বেতন পাইনি। আমাকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো ১৩ হাজার টাকা। বাকি টাকা ঠিকাদার নিয়ে নিতেন।

বিভিন্ন সময়ে এই কর্মচারীরা ঠিকাদার আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান মেলেনি। মেসার্স সারমী ট্রেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলাম নওগাঁ সদরের পারনওগাঁর বাসিন্দা। পরবর্তীতে বেশ কয়েকমাস ধরে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না কেউ। আশরাফুল ইসলামের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকে।

সম্প্রতি গত ১ এপ্রিল এই সেবাপ্রদানকারীরা সিভিল সার্জন অফিস থেকে তাদের কাজ থেকে অব্যাহতির একটি আদেশ পান। এই আদেশ দেখে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অথচ আরও দীর্ঘদিন ধরে তারা নিজেদের বেতন দাবি করে আসছিলেন।   

সোনাতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিকিট কালেক্টর এস এইচ রেজ্জাকুল ইসলাম বলেন, আমরা ঠিকাদার আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এতদিন বলতেন কাজ চলমান আছে। প্রত্যেক মাসে বলেন কাজ চলমান। জানুয়ারিতে গেলে বলে ফেব্রুয়ারিতে বেতন পাবেন। ফোন করলে ফোন ধরেন না। কিন্তু কাজ হয় না। জেলা সিভিল সার্জনের কাছে গেলে তিনিও আমাদের দায়ভার নিতে চান না। তিনি বলেন, আপনারা আমাদের কর্মচারী না। তাহলে আমরা কার কাছে যাব? কার কাছে গেলে সুরাহা পাব?

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ১ এপ্রিলের এই আদেশটির স্মারকটি ২০২৪ সালের। কিন্তু এই আদেশে স্বাক্ষর করা হয় ২০২৩ সালের ২৯ জুন। এই আদেশ ওই সময় না দিয়ে এতদিন পর দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের মাঝে। কারণ ২০২৩ সালের ২৫ জুলাইয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত এই কার্যক্রমের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে এই সেবাপ্রদানকারীরা কাজ করে আসছিলেন।

এ জন্য এই কার্যক্রমকে ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন গাবতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিকিট কালেক্টর আজিজুল হক সুমন। তিনি বলেন, আমরা সিভিল সার্জনের নির্দেশে কাজ করছি। তারপর ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ পর্যন্ত চুক্তিটা ঠিক ছিল। ২২-২৩ অর্থবছরে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এটা সিভিল সার্জন আর ঠিকাদারের বিষয়। এটা তো আমরা বুঝব না। এখন এই ১০ মাসের বেতনভাতা আমরা দাবি করছি। তারা বলছে এই ১০ মাসের কোনো ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি। আর সারা বাংলাদেশে ৪৫৯ জন এমন নিয়োগ হয়। কিন্তু এখানে শুধু বগুড়ার ৩২ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আজিজুল হক বলেন, আমাদের ব্যাকডেটে নোটিশে বলা হচ্ছে ২০২৩-২০২৪ কোনো ঠিকাদার নিয়োগ হয়নি। এখন এই ১০ মাস আমরা যে পরিশ্রম করলাম, তারা মূল্য দিতে চাচ্ছে না। এ সময়ে আমাদের বাদ দিয়ে নতুন কাউকে নেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে এই ১০ মাসের ৬০-৬৫ লাখ টাকা কে নেবে?

‘আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা গ্রহণ নীতিমালা, ২০১৮ এর সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় অংশের ৮ নম্বরে বলা হয়েছে, সেবাক্রয়কারী প্রয়োজনে অর্থ বিভাগের সম্মতি গ্রহণ পূর্বক সেবাগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সরাসরি সেবা প্রদানকারীর সঙ্গেও সেবা ক্রয়ের বিষয়ে চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে।’ 

এই নীতিমালার সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন, নিয়ন্ত্রণ ও চুক্তির অংশের ১ নম্বরে বলা আছে, সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন, নিয়ন্ত্রণ, নিরীক্ষণ, ডাটাবেজ প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যাবলি এবং সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও ব্যবস্থাপনা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ সম্পাদন করবে।’

এসব বিষয় জানতে সারমী ট্রেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দিলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি জেলা সিভিল সার্জন তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ঘটনা আগে থেকেই জানতেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম। কিন্তু এখানে তাদের কিছু করার নেই বলে দাবি করেছেন। কারণ ঠিকাদার নিয়োগ মন্ত্রণালয়ের বিষয়।

সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শফিউল আজম বলেন, তাদের মূলত যোগাযোগ করতে হবে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে। আমাদের কাছে আসার কিছু নেই। তারপরেও মানবিক দিক বিবেচনায় কথা বলেছি। যেহেতু তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন যদি মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হয় তাহলে তারা কাজ করতে পারবে। মানবিক দিক থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে যেন নতুন ঠিকাদার এলেও তারাই থাকতে পারে। গত অর্থবছরের বকেয়া বেতন নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে কথা হয়েছে। এটি ঈদের পরে পরিশোধ করার কথা জানিয়েছে ঠিকাদার।

কেন বকেয়া হয়েছিল এমন প্রশ্নে সিভিল সার্জন বলেন, সমন্বিত বাজেট ও হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতিতে (আইবাস) ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বেতন এই কর্মচারীদের ব্যাংক হিসাবে এসেছিল। কিন্তু আইবাস পদ্ধতিতে টাকা আসার পরপরই টাকা উইথড্রো হয়ে যায়। যার জন্য ওই সময় টাকা তুলতে পারেননি সেবাপ্রদানকারী ওই কর্মচারীরা।

আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এএএ