অযত্নে-অবহেলায় আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর হাবাসপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পটির বেহাল দশা। ভূমিহীনদের স্বপ্নের ঠিকানায় তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। মরিচা ধরে টিনের ছাউনি ও দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। টিউবওয়েল ও শৌচাগারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। 

আবাসন প্রকল্পের ১২০টি ঘরের মধ্যে ৭০টি ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাকিগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরিত্যক্ত ঘরে গরু-ছাগল লালনপালন করা হচ্ছে। বেহালদশার কারণে ৮০ পরিবার আবাসন ছেড়ে চলে গেছে। তারপরও জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভূমিহীন ৪০ হতদরিদ্র পরিবার। দ্রুত সংস্কার করে আশ্রয়ণটি টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন প্রকল্পে আশ্রিতারা।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুস্থ ও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য প্রায় ২০ বছর আগে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের হাবাসপুর গ্রামের পাশে গড়াই নদীর পাড়ে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করা হয়। সরকারের খাস জমির ওপর টিনের দেয়াল ও ছাউনি দিয়ে নির্মিত আবাসন প্রকল্পের এক একটি ব্যারাকে ১০টি করে কক্ষ নির্মাণ করা হয়। ১২০টি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ১২টি ব্যারাক (১২০ টি ঘর) নির্মাণ করে দেয় সরকার। প্রতিটি পরিবারকে একটি করে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তবে অযত্নে-অবহেলা, সংস্কার আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আবাসন প্রকল্পটির এখন বেহাল দশা। পরিত্যক্ত ঘরে গরু-ছাগল রেখে লালনপালন করা হচ্ছে। প্রকল্পের প্রবেশমুখে রাস্তাটিরও বেহাল দশা। পরিত্যক্ত ঘরগুলো আগাছায় ছেয়ে গেছে। বেহালদশার কারণে ৮০ পরিবার আবাসন ছেড়ে চলে গেছে। তারপরও জরাজীর্ণ অবকাঠামোতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ভূমিহীন ৪০ হতদরিদ্র পরিবার। ভূমিহীনদের স্বপ্নের ঠিকানায় তাদের কষ্টের যেন শেষ নেই। দ্রুত সংস্কার করে আবাসনটি টিকিয়ে রাখার দাবি জানিয়েছেন প্রকল্পে আশ্রিতরা।

আবাসন প্রকল্পের ঘরে বসবাসকারী জবেদা খাতুন, রুবেলা, আশরাফুল ইসলাম ও আনোয়ারা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ১৮ বছর আগে বিদ্যুতের মিটার বিস্ফোরণে ১০টি ঘর, একই কারণে সাত বছর আগে আরো ১০টি ঘর এবং দুই বছর আগে আরও ১০টি ঘর পুড়ে গেছে। সেইসব ঘর সংস্কার করা হয়নি। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে আমার যেসব ঘরে বসবাস করি, সেগুলোও ভাঙাচোরা, ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। জরাজীর্ণ ঘরে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে আছি। ১২টি টিউবওয়েলের মধ্যে ১০টি অনেক আগে নষ্ট হয়ে গেছে। দুটি টিউবওয়েল থাকলেও ঠিকমতো পানি ওঠে না। বাথরুমগুলোও অনেক আগে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে গেছে। টিউবওয়েল ও বাথরুমের অভাবে আমাদের খুব কষ্ট হয়। অনেক দূরে থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে। নদীর চরে টয়লেট করতে হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভাঙা টিনের ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। ঘরের জিনিসপত্র ও বিছানা ভিজে যায়। আমরা অনেক কষ্টে আছি। এখানে অনেক মানুষ বসবাস করতো। সমস্যার কারণে ৮০ পরিবারের মানুষ চলে গেছে। আমরা ৪০ পরিবার কষ্ট করে পড়ে আছি। টিউবওয়েল ও বাথরুম ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। দ্রুত ঘর সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি।

হাবাসপুর আবাসনের সভাপতি আজাদ শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এই আবাসনে ১৯ বছর ধরে বসবাস করছি। প্রায় ১৮ বছর আগে বিদ্যুতের মিটার বিস্ফোরণে একটা ১০ রুমের ব্যারাক পুড়ে যায়। এরপর একই কারণে আরও দুটি ব্যারাকের ২০টি ঘর পুড়ে যায়। পুড়ে যাওয়া ৩০টি ঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যান্য ঘরগুলোও জরাজীর্ণ অবস্থা। টিউবওয়েল, বাথরুম, যাতায়াতের রাস্তা ও ঘরের খুবই সমস্যা। এগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। ঘরের টিন পচে গেছে, ভেঙে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি পড়ে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে এখান থেকে অনেক মানুষ চলে গেছে। ১২০ পরিবারের মধ্যে এখন ৪০ পরিবার এখানে বসবাস করে। বাকি ৮০ পরিবার চলে গেছে। তারা কুষ্টিয়া শহরে ভাড়া বাসায় থাকে, ভ্যান-রিকশা চালায়, কেউ কেউ দিনমজুর। 

আবাসন প্রকল্পের ঘরে বসবাসকারী মর্জিনা খাতুন বলেন, নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের আবাসন। ঘরের টিন পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি চলে আসে। আমরা বর্তমানে বসবাসের অযোগ্য ঘরে বাস করছি। কিন্তু সেগুলো সংস্কার করা হয় না। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

৭০ বছর বয়সী রিজিয়া খাতুন বলেন, এই আবাসন চালু হওয়ার এক সপ্তাহ পরে আমরা এখানে এসেছি। ভূমিহীন গরিব মানুষ আমরা। জায়গা জমি নেই বলেই এখানে থাকি। আমাদের ঘর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। এখন আমাদের খুবই কষ্ট। সেই কষ্টের কথা বলা যায় না। বৃষ্টি আসলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে পাখির মতো ঘরের এক কোণে বসে থাকি। এখান থেকে অনেকে চলে গেছে। আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আপনারা আমাদের সমস্যাগুলো সমাধান করে দেন। সরকারের কাছে দ্রুত সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি। সরকার যদি প্রকল্পের ঘরগুলো মেরামত করে দেয়, বাথরুম ও টিউবওয়েল দেয়, তাহলে আমাদের জন্য ভালো হবে। সবাই সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারবে।

নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান খোকন ও নন্দলালপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৬নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নয়ন আলীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি। 

কুমারখালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাইদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবাসন প্রকল্পের সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। বরাদ্দের জন্য আবেদন করা হয়েছে। বরাদ্দ এলে তাদের সমস্যা সমাধান করা হবে। 

এ বিষয়ে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, আমি একটা মিটিংয়ে আছি। এখন কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না। পরে কথা বলব। 

রাজু আহমেদ/আরকে