শেরপুর আলোকিত করছেন জ্যোতি
‘ছোটবেলায় বড় ভাইয়া সম্রাটের সঙ্গে শেরপুর স্টেডিয়ামে যেতাম। অনেক সময় ভাইয়ার সঙ্গে খেলতাম। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। ভাইয়া নিজেও জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটি সম্ভব হয়নি। তাই তিনি সব সময় আমাকে উৎসাহ দিতেন এবং বলতেন, জ্যোতি, তুই একদিন ঠিকই জাতীয় দলে খেলবি।’
এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা পোস্টকে এমনটিই বলছিলেন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের অন্যতম ব্যাটসম্যান ও উইকেট কিপার নিগার সুলতানা জ্যোতি।
বিজ্ঞাপন
জ্যোতি শেরপুর জেলা শহরের রাজভল্লভপুর মহল্লার মো. সিরাজুল হক ও সালমা হক দম্পতির দ্বিতীয় মেয়ে।
২০১৪ সালে ন্যাশনাল ক্যাম্পে ডাক পাই। তখন টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ চলছে। সিলেকশনে থেকেও আমাকে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তখন জেদ করে আরও পরিশ্রম করতে শুরু করলাম, বেশি বেশি অনুশীলন করতাম। তারপর পেলাম স্বপ্নের দেখা।
কথোপকথনে জ্যোতি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্রিকেটে আমার হাতেখড়ি পরিবার থেকে হলেও আমাকে যিনি তৈরি করেছেন, তিনি আমার বন্ধুর বাবা মুখলেছুর রহমান স্বপন। তার সহযোগিতায় আমি প্রথম বিকেএসপিতে ডাক পাই। কিন্তু তখন আমি অতটা ভালো করতে পারিনি। এরপর শেরপুর ফিরে এসে প্রচুর অনুশীলন করতাম। সব সময় মাঠে থাকতাম। তারই ধারাবাহিকতায় ব্যাটিং ও ভালো ফিল্ডিংয়ের জন্য ২০১১ সালে শেখ জামালের হয়ে খেলি। তখন শেখ জামালে সব তারকা খেলোয়াড় খেলেন।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, সে সময় আনসার বাহিনীর একজন কোচ ছিলেন ফরিদা। তিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তিনি আমাকে যথেষ্ট গাইড করেছেন। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এরপর ২০১২ সালে ভালো খেলার কারণে প্রথম একটি চেক পাই। তখনো জানতাম না যে খেলে টাকা আয় করা যায়।
তিনি বলেন, মা আমাকে এ কাজে যথেষ্ট সাপোর্ট দিতেন। ২০১৫ সালে জাতীয় দলে আবারও ডাক পাই। তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমার অভিষেক হয়। এরপর আর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কারণ সব সময় দলের হয়ে হাইয়েস্ট বা দ্বিতীয় হাইয়েস্ট স্কোরার ছিলাম।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে তিনটি টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ খেলেছি। এখন একটাই আশা যেন একটি ওডিআই বিশ্বকাপ খেলতে পারি, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
নিগার সুলতানা জ্যোতির বাবা মো. সিরাজুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শেরপুরের মতো একটি মফস্বল শহর থেকে জ্যোতির জন্য ক্রিকেট খেলাটা অতটা সহজ ছিল না। জ্যোতি যখন বল ধরতে পারে, তখন থেকেই সে ক্রিকেটে আগ্রহী। তার প্রথম আইডল ছিল তার সহোদর বড় ভাই সম্রাট। তার কাছ থেকেই জ্যোতি সব অনুপ্রেরণা পেত।
তিনি বলেন, বাবা হিসেবে সব সময় তাকে সাপোর্ট দিয়েছি। ভোরবেলায় মোটরবাইকে করে তাকে অনুশীলনের জন্য স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম। জ্যোতির খেলা যখন গ্যালারিতে বসে দেখতাম, তখন কতজন কতশত বাজে কথা বলত। স্থানীয় অনেক হুজুর বলতেন আমরা জাহান্নামি। মাথা নিচু করে সব সহ্য করতাম। আজ আমি গর্বিত।
সিরাজুল হক বলেন, নারী বিশ্বকাপে যখন বাংলাদেশ শিরোপা জিতল, তখন সেসব মানুষই আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, বাহবা দিয়েছেন। কারণ, নারী বিশ্বকাপ জেতার অন্যতম কারিগর ছিল আমার মেয়ে জ্যোতি।
আইডিয়াল ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষক রাজিব আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জ্যোতির উদাহরণ সে নিজেই। আজকে তার অবস্থানের জন্য জ্যোতির অনেক ইচ্ছাশক্তি ছিল। তার পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই তাকে সাপোর্ট করেছে। আমার ক্রিকেট একাডেমিতে ১০ থেকে ১৫ জন নারী ক্রিকেটার প্রশিক্ষণ নেয়। জ্যোতি তাদের ব্যাট, বলসহ সব সরঞ্জামাদি কেনার জন্য খরচ বহন করে। শেরপুর এলেই জ্যোতি তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য ক্রিকেট একাডেমিতে ছুটে আসে। বর্তমানে অনেক মা-বাবা তাদের মেয়েদের নিয়ে আমার এখানে ছুটে আসে। এটা শুধু জ্যোতিকে অনুসরণ করেই।
শেরপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার অতিরিক্ত সাধারণ সম্পাদক ও জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মানিক দত্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, জ্যোতির জন্য পুরো বিশ্ব শেরপুরকে চিনবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্টেডিয়ামের এই মাঠেই জ্যোতি ক্রিকেট খেলত। আমরা আশা করি জ্যোতিকে অনুসরণ করে শেরপুরে আরও নারী খেলোয়াড় তৈরি হবে। যারা একদিন জাতীয় দলের নেতৃত্ব দেবে। সে জন্য শেরপুরের অভিবাবকরা যেন ক্রিকেট ও ফুটবলে তাদের মেয়েদর উৎসাহিত করে এবং পরিবার থেকে যেন তাদের সব ধরনের সুযোগ দেয়।
উল্লেখ্য, এশিয়া কাপের ফাইনালে ছয়বারের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। আর সেই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শেরপুরের মেয়ে নিগার সুলতানা জ্যোতি। ২৪ বলে তার ২৭ রানের (দলীয় সর্বোচ্চ) অনবদ্য ইনিংসের ওপর ভর করেই কুয়ালালামপুরের কিনরারা একাডেমি ওভাল স্টেডিয়ামে স্বগৌরবে উড়েছিল বাংলাদেশের পতাকা।
টাইগ্রিসদের এ জয় যেন এক ঐতিহাসিক মঞ্চ রচনা। এশিয়া কাপের ছয় আসরের সব কটিতেই চ্যাম্পিয়ন শিরোপা ঘরে তুলেছে ভারত। কিন্তু সেবার প্রথমবার ফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ। সে হিসাবে ফাইনালে একেবারেই অনভিজ্ঞ একটি দল বাংলাদেশ। কিন্তু শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলেছিল বাংলাদেশ।
এনএ