দক্ষিণাঞ্চলের শেষ জেলা সাতক্ষীরা। জেলার সর্বশেষ উপকূলীয় জনপদ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়ন। চারপাশে নদীবেষ্টিত ইউনিয়নটি দ্বীপ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত। উন্নয়নের মহাসড়কে যখন দেশ তখনো চরম অবহেলিত ইউনিয়নটি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারবঞ্চিত এখানের বাসিন্দারা।

ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মতে, এখানে নানা সমস্যা। কোনটা রেখে কোনটা বলব। আমরা ডিজিটাল দেশের মানুষ, ভাবতেও কষ্ট হয়। সব মৌলিক অধিকারবঞ্চিত আমরা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ অবস্থা। চিকিৎসার জন্য তিন ঘণ্টার নদীপথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যায় রোগীরা।

উপকূলীয় মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন ঢাকা পোস্টের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্ব আজ।

‘কেউ যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আল্লাহ বাঁচালে বাঁচলেন; না হয় শ্যামনগর-সাতক্ষীরা হাসপাতালে পৌঁছানোর পথেই জীবন শেষ। চিকিৎসক-কবিরাজ দেখানো হয় না। এমন অনুন্নত এলাকা বোধহয় দেশের কোথাও নেই। জন্ম থেকেই দেখছি; কোনো উন্নয়ন হয়নি।’ এভাবেই কথাগুলো বললেন গাবুরা ইউনিয়নের সোরা গ্রামের বাসিন্দা মুরশিদ আলী (৫৫)। তিনি এই গ্রামের মৃত ওসমান আলীর ছেলে।

গাবুরা থেকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে লাগে তিন ঘণ্টা

মুরশিদ আলী বলেন, আমরা কীভাবে বেঁচে আছি; সেটি যারা এখানে এসেছেন তারা দেখেছেন। উন্নয়নের আসল চিত্র তারাই জানেন। সরকারের সাহায্য ও উন্নয়ন এখানের মানুষ পায় না। যদিও একটু আসে তা খেয়ে ফেলেন জনপ্রতিনিধিরা। আমাদের ভাগ্যে জোটে না কিছুই।

ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা গ্রামের খায়রুল ইসলাম সময়মতো অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে পারেননি। ফলে তার সন্তান মারা যায়।

খায়রুল ইসলাম বলেন, ভোররাতে যখন স্ত্রীর প্রসবব্যথা শুরু হয় তখন চিকিৎসা করাতে পারিনি। গ্রাম্য চিকিৎসক প্রথম দিকে ভরসা দিলেও পরবর্তীতে আশা ছেড়ে দেন।

তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তা নেই। অসুস্থ স্ত্রীকে নদীপথে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যেতে লেগে যায় তিন ঘণ্টা। সেখান থেকে রেফার্ড করে দেওয়া হয় সাতক্ষীরা মেডিকেলে। সেখান থেকে খুলনা মেডিকেলে রেফার্ড করা হয়। খুলনায় নিতে না পেরে সাতক্ষীরা শহরের একটি ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করানো হয়। ততক্ষণে স্ত্রীর গর্ভের সন্তান মারা যায়। এত চেষ্টা করেও সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি। এমন ঘটনা আর কারও ভাগ্যে যেন না ঘটে। গাবুরায় একটা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দাবি জানাই। অন্তত বেঁচে যাব আমরা।

সময়মতো চিকিৎসা করাতে না পেরে চাঁদনিমুখা গ্রামের আজিজুল ইসলাম এখন প্যারালাইজড। তিনি এখন শয্যাশায়ী। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভেঙে যাওয়া দোকান মেরামতের সময় তিনি হঠাৎ অসুস্থ হন। খুলনায় নিয়ে যেতে সময় লাগে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা। চিকিৎসক জানিয়ে দেন, আসতে দেরি করে ফেলেছেন। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে ওষুধ চালিয়ে নিতে হবে।

আজিজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আছুরা বেগম

আজিজুল ইসলামের স্ত্রী আছুরা বেগম বলেন, সময়মতো চিকিৎসা করতে না পারায় শরীরের বাঁ পাশ অবশ হয়ে গেছে স্বামীর। এখন চলাফেরা করতে পারেন না। স্বামীর ফার্নিচারের দোকানটি এখন আমি দেখি। আমাদের এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এভাবে বেঁচে আছি। কয়েকটা কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। সেখানে গেলে সর্দি-কাশির ওষুধ ছাড়া কোনো চিকিৎসা পাই না। 

গ্রামের ব্যবসায়ী খালিদ হাসান বলেন, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই গাবুরার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। ন্যূনতম সেবাও পাই না। মৌলিক অধিকারবঞ্চিত আমরা। চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান সবদিকেই গাবুরার মানুষ পিছিয়ে। এখানে কোনো উন্নয়ন হয় না।

২০০৯ সালে আইলার পর সোরা গ্রামের শামসুর রহমানের ছেলে জিয়াউর রহমান নিজের বসতভিটার এক বিঘা জমি ফেলে এখন বসবাস করেন বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালি গ্রামে। 

জিয়াউর রহমান বলেন, গাবুরা এলাকার সমস্যা নিয়ে; কোনটা রেখে কোনটা বলব। আমি নিজেই জমিজমা ফেলে রেখে চলে এসেছি। ওখানে বসবাস অনুপযোগী। খাবার পানি নেই, রাস্তাঘাট নেই, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। টাকা থাকলেও পছন্দের পোশাক কিনতে পারি না। কিছুদিন পর পর বাঁধ ভেঙে ঘরবাড়ি নষ্ট হয়। সহায়-সম্পদ ভেসে যায়।

ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস, মানুষের কষ্টের শেষ নেই, যাতায়াত ব্যবস্থা নেই

গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম বলেন, ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস। মানুষের কষ্টের শেষ নেই। যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসা পায় না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে থাকতে হয়। তবে ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা, পার্শেমারি, ডুমুরিয়া ও গাবুরায় চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে সর্দি, কাশি ও জ্বর হলে মাঝেমধ্যে ওষুধপত্র দেওয়া হয়। এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। নদী পার হয়ে সময়মতো চিকিৎসকের কাছে পৌঁছাতে না পেরে অনেক মানুষ মারা গেছে।

তিনি বলেন, ব্রতি নামের একটি বেসরকারি এনজিও এখানের মানুষের দুর্দশা দেখে নদীতে ট্রলারের মাধ্যমে একজন এমবিবিএস চিকিৎসককে দিয়ে সেবা দেয়। সেজন্য এনজিওকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এখানের উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া উচিত সরকারের।

সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন সাফায়াত বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণে গাবুরা ইউনিয়নে হাসপাতাল দেওয়া কঠিন। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় রোগীদের শ্যামনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনতে মারা যায়। কেউ কেউ ভাগ্যগুণে বেঁচে যায়। নদীবেষ্টিত হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হচ্ছে না। তবে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। আমরা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে রেফার্ড করি।

এএম