বয়সের ভারে ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না ষাটোর্ধ্ব রওনা বেগম। তবে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম থেমে নেই তার। মাঝরাতে বিশেষভাবে তৈরি জাল নিয়ে কপোতাক্ষের বুকে নেমে পড়েন। শেষ রাতে কয়েকটা মাছ ধরে বাড়ি ফেরেন, কোনোদিন খালি হাতে। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যান কপোতাক্ষে। এভাবে দিনরাত মাছ ধরে তা বিক্রি করে সংসার চালান রওনা বেগম।

চার ছেলে এক মেয়ে নিয়ে স্বামীহারা রওনা বেগমের সংসার। সন্তানেরা নিজেরাই নিজেদের পরিবার চালাতে হিমশিম খান। প্রতি বছর নদীভাঙন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন না তারা। ফলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও রওনা বেগমকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়।

খুলনার উপকূলবর্তী উপজেলা কয়রার কপোতাক্ষ নদঘেঁষা ছোট গ্রাম দশহালিয়া। গ্রামের কপোতাক্ষ নদের পাড়েই বাড়ি রওনা বেগমের। জীবন-সংগ্রামে বারবার হোঁচট খেতে হয় তাকে। দুঃখ আর দুর্যোগকে সঙ্গী করেই বসবাস করছেন এখানে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে কপোতাক্ষ নদ। নদের দুঃখকে নিজের করে নিয়ে পার করেছেন জীবনের ৬০টি বছর। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফনি, বুলবুল আম্পানসহ অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাছ থেকে দেখেছেন রওনা বেগম। এজন্য ভয় কেটে গেছে। দিনরাত কপোতাক্ষের বুকে জাল টেনে পান ২০-৫০ অথবা ১০০ টাকা। রওনা বেগম জানেন না কবে সুখী হবেন। আর কত বয়স হলে সুখের দেখা পাবেন।

দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম থেমে নেই রওনা বেগমের

জীবন সংগ্রামের গল্প শুনতে চাইলে রওনা বেগম বলেন, দুপুর দুটোর সময় আসি আর চারটার সময় যাই। ইনকাম কোনোদিন ১০০ টাকা হয়, কোনোদিন ৫০ আবার কোনোদিন ২০ টাকা হয়। কালকে রাত্তিরি করছিলাম ২০০ টাকা, রাত একটার সময় আসি। আর সেহরি করার সময় চলে যায় বাড়ি। সেহরি করে আবার আসতি চাইলাম, কিন্তু আসতি পারিনি, কষ্ট হয়ে গেল।

দিনের বেলা যদি ২০টা মাছ হয় তাইলে রাত্তিরে হয় ১০০, রাত্তির বেলা একটু বেশি মাছ পড়ে আর দিনে কম। আজকে ৭০টা গলদা মাছের পোনা আর ৫৫টা বাগদা পোনা পায়ছি। ৭০টা গলদা পোনা ১৪০ টাকা আর ৫৫টা বাগদা পোনা ৫৫ টাকা। এই কাজে খুব কষ্ট হয়, যখন আর পেরে উঠি না তখন বাড়িতে যেয়ে একটু শুয়ে থাকি। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ি। কষ্টের কথা আর বলব কাকে? কষ্টের কথা শোনার কেউ নেই আমার।

তিনি বলেন, গোনমুখে একটু মাছ বেশি হয়, তারপর আবার ভাটিঘা আসলি মাছ কুমে যায়। এখন গোনমুখ চলে। এজন্যি মাছ বেশি। কদিন পর আবার কুমে যাবে। তখন রাতদিন খেটে ২০-৫০ টাকা, কখনো ১০০ টাকা ইনকাম হবে। এভাবে জীবন চলে না, কিন্তু কি আর করব।

নদীতে জাল টানছেন রওনা বেগম

শুধু রওনা বেগম নন; দশহালিয়া গ্রামের কপোতাক্ষ নদের কূলে বসবাস করা অন্তত শতাধিক নারীর গল্পও রওনা বেগমের মতো। জমিরন, রমিছা, পারভিন বেগমসহ শতাধিক অসহায়, স্বামীহারা নারীর জীবন ও জীবিকার গল্প এক সুতায় বাঁধা।

মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রান্তিক নারীদের এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সরকারি নানা প্রকল্প আছে, পাশাপাশি নানা এনজিও কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা উপকূলীয় নারীরা পেয়ে থাকেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এসব নারীকে দেওয়া হয়। তবে সেসব পর্যাপ্ত না।

এএম