ভোটকেন্দ্রের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিলেন বিটুল মিয়া নামে একজন ভোটার। ভোটগ্রহণ শুরুর দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তিনি ভোট দিতে যাননি। কারণ জানতে চাইলে কিছুটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন তিনি। 

উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই দাবি করে বিটুল মিয়া বলেন, ভোট দিয়ে কী হবে? আগের মতো ভোটের পরিবেশ নেই। সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া কী ভোট জমে? এখানে চেয়ারম্যান পদে দুইজনই আওয়ামী লীগের, তারা আবার সম্পর্কে আপন খালাতো ভাই। মানুষের ভোট দেওয়ার আগ্রহ নষ্ট হয়ে গেছে। 

বিটুল মিয়া রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকার ভোটার। 

বুধবার (৫ জুন) সকালে তার সঙ্গে কুতুবপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে কথা হয়। ওই কেন্দ্রের বাইরে কর্মী সমর্থকদের সরব উপস্থিতি দেখা গেলেও কেন্দ্রে তেমন ভোটার দেখা যায়নি।

বদরগঞ্জের রাধানগর পাঠানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ষাটোর্ধ্ব বয়সী খাদেমুল ইসলাম। ভ্যানে চড়ে ভোট দিতে এসেছিলেন তিনি। ভোটার পরিবেশ সম্পর্কে ঢাকা পোস্টকে এই বৃদ্ধ বলেন, একসময় নির্বাচন মানে উৎসব ছিল। সকাল সকাল মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেত। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ভোট দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এখন আর সেই দৃশ্য নেই। প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ডেকে আনার চেষ্টা করছে। তারপরও ভোটকেন্দ্রগুলো ফাঁকা রয়েছে। কারো তেমন সাড়া নেই বললেই চলে। বাসায় কাজ নেই তাই ভোটটা দিলাম।

গোপিনাথপুর ইউনিয়নের লালদিঘী ও/এ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে কথা হয় নুরনাহার বেগমের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকলে ভালো লাগে। কিন্তু এখন তো মানুষের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখি না। আমার আত্মীয় ভোটে দাঁড়িয়েছে এজন্য সকালে এসেই আগে ভোটটা দিলাম। আমার কোনো সমস্যা হয়নি। নিরিবিলি পরিবেশ, পুরো কেন্দ্র ফাঁকা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভালো রয়েছে।

একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বদরগঞ্জ উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২২ হাজার ৭২১ জন আর নারী ১ লাখ ২০ হাজার ৩৩৯ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন আটজন। সকাল আটটা থেকে ১০৩টি কেন্দ্রে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি কম হলেও এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

লালদিঘী ও/এ উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তপন কুমার সরকার জানান, তার কেন্দ্রে দুই ঘণ্টায় (সকাল দশটা পর্যন্ত) ৭৬ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। ছয়টি বুথের মধ্যে একটি বুথে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে। 

অন্যদিকে রাধানগর পাঠানপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়‌‌ ভোটকেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, সকাল আটটা থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ধান কাটা মাড়াইসহ কৃষি কাজের কারণে সকাল বেলা তেমন ভোটার উপস্থিতি নেই। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার। সকাল নয়টা পর্যন্ত এক ঘণ্টায় ১১ জন ভোট দিয়েছেন। দুপুরের পর থেকে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে বলে আশা করছি।

গোপিনাথপুর ইউনিয়নের ঝাড়খন্ড মৌয়াগাছ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা শামীম আল মামুন বলেন, দুই ঘণ্টায় ২ হাজার ৯০৪ জন ভোটারের মধ্যে ১৩০ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। 

এদিকে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোট নিয়ে এখন আর সাধারণ ভোটাররা চিন্তাভাবনা করেন না। নির্বাচন ঘিরে আগের মতো আমেজও নেই ভোটারদের মধ্যে। এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যত আমেজ ও উত্তাপ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাদের কর্মীদের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। সাধারণ ভোটাররা রয়েছেন নিশ্চুপ।

বদরগঞ্জ পৌর এলাকাসহ কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ৪০ জন সাধারণ ভোটার এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বী, তিন প্রার্থী, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সচেতন সাধারণ ভোটাররা অধিকাংশই ভোট দিতে যাবেন না। 

তাদের ভাষায় তিন শ্রেণির ভোটার ভোট দিবেন, এক নম্বর আওয়ামী লীগের নেতা ও কঠোর সমর্থকেরা। দুই নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে পছন্দ করেন এমন কতিপয় অনুসারী, প্রার্থীর স্বজন ও নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অংশ নেওয়া কর্মীরা। তিন নম্বর, সুবিধা নেওয়া গরিব শ্রেণির কতিপয় নারী ও পুরুষ ভোটার। এই তিন নম্বর শ্রেণির ভোটাররা সব ধরনের ভোটেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কাছে ভোটের আগে ও ভোটের দিন ওই সুবিধা নিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিবেন।

বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে দুই খালাতো ভাই মুখোমুখি অবস্থানে। তারা হলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলে রাব্বী সুইট ও উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক হাসান তবিকুর চৌধুরী। তারা উভয়ই নির্বাচনে জোরেশোরে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। দুই খালাতো ভাইকে ভোট দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ভোটার ও আত্মীয়স্বজনরা। 

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দুজনই লড়ছেন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে রেজাউল করিম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে রুবিনা আখতার (ফুটবল), আফরোজা বেগম (কলস) ও লিপি ইয়াসমিন (প্রজাপতি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। 

এদিকে বদরগঞ্জ ছাড়াও রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তারাগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা, বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান লিটন ও জাতীয় পার্টির উপজেলা আহ্বায়ক শাহিনুর ইসলাম মার্শাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। 

পাঁচটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত তারাগঞ্জ উপজেলায় মোট ভোটার ১ লাখ ১৯ হাজার ২২২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬০ হাজার ৪৯৮ জন। আর নারী ৫৮ হাজার ৭২৪ জন। এখানে ৫৫টি ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। 

এ নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য ২ হাজার ১২৬ জন আনসার, কেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে ৬৫০ জন পুলিশ কাজ করছে। এ ছাড়া ৮ প্লাটুন বিজিবি, ১৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং পর্যাপ্তসংখ্যক র‌্যাবের সদস্য স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। 

রিটার্নিং কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শাহনাজ পারভীন বলেন, পুলিশ ও আনসারের উপস্থিতিতে নির্বাচনসামগ্রী নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসাররা কেন্দ্রে পৌঁছে গেছেন। ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে এসে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ফিরে যেতে পারেন, সে লক্ষ্যে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রার্থী, ভোটারসহ সবার সহযোগিতায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যাশা করছি। 

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএএ