জাহাজের অপরিশোধিত পানিতে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন ঘষিয়াখালীবাসী

ঘুর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার আগে থেকেই জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করে নদী বেষ্টিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়ন জুড়ে। ঝড়ের রাতে পুরো ইউনিয়ন ডুবে যায় তিন পাশের কেওড়া, মানিক ও পানগুছি নদী থেকে উঠে আসা জলোচ্ছ্বাসের পানিতে। নদী তীরবর্তী ঘষিয়াখালী, ফুলহাতা, বহরবুনিয়া গ্রামের পুরোটাই ডুবে যায় জলোচ্ছ্বাসের পানিতে। বেড়িবাঁধ না থাকা এই অঞ্চল ঝড় শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ডুবেছে কয়েকবার।

বাগেরহাট শহর থেকে সড়ক পথে রামপাল উপজেলার মল্লিকের বের খেয়া ঘাটের অপরপাশে ঘষিয়াখালী লঞ্চঘাট। খেয়াপাড় হয়ে লঞ্চঘাট থেকে উপরে উঠলেই বহরবুনিয়া ইউনিয়নের ঘষিয়াখালী বাজার। বাজারের রাস্তার পাশেই রয়েছে জেলা পরিষদরের বিশালাকৃতির এক পুকুর। এই পুকুরের পানি পান ও রান্নার কাজে ব্যবহার করেন স্থানীয়রা। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে পুকুরটি।

ঝড়ের এক সপ্তাহ পরে সোমবার (৩ জুন) সকালে ঘষিয়াখালী বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সুপেয় পানির একমাত্র উৎস সেই পুকুরটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একশ ফুটের বেশি পাড় ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। দক্ষিণপাড়ের মাঝখান দিয়েও প্রায় ৫০ ফুটও ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। পাড়ে থাকা কনক্রিটের পিলারও উপড়ে পড়েছে। ঝড়ের ৮দিনেও পুকুরের পাড় মেরামতের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। কবে নাগাদ পুকুর সংস্কার করা হবে তাও জানেন না স্থানীয়রা।

কথা হয় পুকুর পাড়ে থাকা ঘষিয়াখালী বাজারের ব্যবসায়ী আজাদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘষিয়াখালী বাজারের ১৩১টি দোকান ও ২ শতাধিক ব্যবসায়ী রয়েছে। তারা সবাই এই পুকুরের পানি পান ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতেন। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ঘষিয়াখালী ও আশপাশ এলাকার অন্তত ৫ হাজার মানুষ এই পুকুরের পানি পান করেন। কিন্তু পুকুরের পানি লবণাক্ত হয়ে যাওয়ায় খুব সমস্যায় পড়েছেন তারা।

গেল ৩ মে ঢাকা পোস্টের সরজমিনে কথা হয় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে।

ঘষিয়াখালী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম খলিফা বলেন, ঝড়ের পুকুরটির পাড় ভেঙে যাওয়ার ৮দিন পরেও চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি বা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কেউ পুকুরটি মেরামতের কোন উদ্যোগ নেয়নি। কেউ দেখতেও আসেনি। খুবই পানির কষ্টে আছেন স্থানীয়রা। অতিদ্রুত এই এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ ও পুকুর মেরামতের দাবি জানান এই ব্যবসায়ী নেতা।

বাজার থেকে একটু পূর্ব দিকে গেলেই মোংলা বন্দরের ঘষিয়াখালী চ্যানেল। লোকায় দিয়ে হেটে চ্যানেলের পাড়ে গেলে চোখে পড়ে এক বিশেষ দৃশ্য। স্থানীয় দুই যুবক ট্রলারে কলস নিয়ে চ্যানেলের মাঝখানে একটি জাহাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন। অনুরোধ করে তাদের সাথে যুক্ত হলে জানা যায়, ঝড়ের পর থেকে জাহাজের পানিতেই চলছে তাদের। জাহাজের মাস্টার-নাবিকদের অনুরোধ ও মাঝে মাঝে উপঢৌকন দিয়ে তারা জাহাজ থেকে পানি নেয়। কয়েক মিনিটে কলস নিয়ে জাহাজে পৌঁছায় রবিউল ও তার সহযোগী। জাহাজে উঠে নাবিকদের অনুমতি নিয়ে জাহাজের রিজার্ভার থেকে পানি ভরলেন কলসে।

এসময় কথা হয় জাহাজের ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সাথে। তিনি জানান, মূলত মেঘনা নদী থেকে রিজার্ভারে পানি ভরে নিয়ে আসেন তারা। তাদের রিজার্ভারে ৫ থেকে ৬ হাজার লিটার পানি ধরে। একবারের ট্রিপে সব পানি ব্যবহার হয় না। তাই ঘষিয়াখালী এলাকায় যখন জাহাজ নোঙ্গর করা থাকে তখন স্থানীয়রা কলস নিয়ে আসলে তাদের পানি দেন তারা।

জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করা যুবক রবিউল জানান, মোংলা বন্দর ও খুলনা-নওয়াপাড়া এলাকায় যাওয়া-আসা করা জাহাজ যাত্রাপথে চ্যানেলের ঘষিয়াখালী এলাকায় প্রায়ই নোঙ্গর করে। তারা আগেও বিভিন্ন সময় জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করতেন। তবে ঝড়ের পরে জাহাজের পানিই একমাত্র ভরসা তাদের। এলাকার বেশিরভাগ মানুষ এখন জাহাজ খেকে পানি নেয়। কেউ কেউ বিনামূল্যে নেয়, আবার কেউ ছোট খাট খাদ্যপন্য যেমন, কচু, তালশ্বাস, সিগারেট ও ছোট মুরগির বাচ্চার বিনময়েও পানি নেয়। তবে কেউ কেউ লঞ্চে করে বাগেরহাট সদর ও রামপালের সন্নাসী বাজার থেকে বোতলের পানি ক্রয় করে আনে। তবে সে সামর্থ্য এলাকার অধিকাংশ মানুষের নেই। শুধু রবিউল নয়, এলাকার অনেক যুবকই এখন অপেক্ষায় থাকেন জাহাজ থেকে পানি সংগ্রহ করার। শুধু ঘষিয়াখালী নয়, বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই সুপেয় পানির তীব্র সংকট। সংকট রয়েছে মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা ও কচুয়া উপজেলার অধিকাংশ এলাকায়।

ঘসিয়াখালী  লঞ্চঘাট বাজারের পল্লী চিকিৎসক ইমরান হোসেন মামুন বলেন, আমাদের এলাকার লবণ পানির করনে প্রচুর পরিমাণ চর্মরোগ বেড়েছে। এই রোগ করমে না। এইখান থেকে  মানুষ শহরে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসে তবে তা আবার বেড়ে লবনাক্তার কারনে বেড়ে যায়। তবে এই লবণাক্তার করনে এই  এলাকার নারীরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ  রয়েছে। 

এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাগেরহাটের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্নিঝড় রেমালে এ জেলায় ২০ হাজার ২২৬ টি সুপেয় পানির উৎস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে নলকুপ, রেইন ওয়াটার হার্বেস্টিং ট্যাংকি, পিএসএফ ও পুকুর রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্ত মল্লিক বলেন, ঝড়ের ফলে জেলার বিপুল পরিমাণ পানির উৎস্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সংকট মেটাতে মোংলা, মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলায় ৩টি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা থেকে প্রতিদিনি প্রায় ৭ হাজার লিটার পানি পাচ্ছেন দুর্গত মানুষেরা। 

তিনি আরও বলেন, বহরবুনিয়া ইউনিয়নেও তীব্র পানির সংকট রয়েছে। ইউনিয়নটিতে সরাসরি সড়ক পথে কোনো যানবাহন যায় না। যার ফলে এখন পর্যন্ত সুপেয় পানির জন্য কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে যতদ্রুত সম্ভব বহরবুনিয়া ইউনিয়নের সর্বত্রই পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।

শেখ আবু তালেব/আরকে