‘আড়াইশ—আড়াইশ বাউফল-বগা মাত্তর আড়াইশ’ বরিশাল বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সামনে উচ্চস্বরে যাত্রী ডাকছিলেন সেলিম মিয়া। সিএনজিচালিত থ্রি-হুইলারে ইতোমধ্যে তিনজন যাত্রী দরদামে বনিবনা হওয়ায় বসেছেন। আর দুজন যাত্রী হলেই তিনি যাত্রা শুরু করবেন। 

সেলিম মিয়া বলেন, ‘ঈদের এ কয়দিন ট্রিপ না দিলে চলমু কেমনে? বৎসরে আয়-রোজগার করি দুই ঈদে। ঈদের আগের তিনদিন মাত্র ৪ ঘণ্টা ঘুমামু। বাকি সময় ট্রিপ মারমু। ঈদের পরবর্তী তিন-চারদিনও মোটামুটি প্যাসেঞ্জার পামু।’ কথা বলতে বলতে আবারও যাত্রী তুলতে গলা ছাড়লেন।

বরিশাল নগরীর নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগা লঞ্চঘাটের দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটারের বেশি। বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়ক দিয়েই বগা যেতে হয় থ্রি-হুইলারগুলোকে। যদিও উচ্চ আদালত মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। সরকারেরও কড়া নির্দেশনা মহাসড়কে যেন থ্রি-হুইলার না চলে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে থ্রি-হুইলার চলতে দেওয়া হবে না বলে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

৬৮ কিলোমিটার পারি দিয়ে থ্রি-হুইলার শুধু যে বগা যায় এমন নয়। বরিশাল থেকে ৫১ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিয়ে ভান্ডারিয়া, ৪০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কাউখালী, ৫১ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ, ৪৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পটুয়াখালী সদর, ৫৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে বরগুনার বেতাগী, ২২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঝালকাঠি সদর, ৩৪ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে রাজাপুরসহ বিভাগের প্রতিটি উপজেলায় যাচ্ছে থ্রি-হুইলার। দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ টিমের সামনেই যাত্রী তুলে বাস-ট্রাকের মত ভারী যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহাসড়কে ছুটছে এসব যান। 

গত শুক্রবার (১৪ জুন) সকালে সাইদুল ইসলাম তার সিএনজি নিয়ে বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে সেনাবাহিনীর একটি গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে আরেকটি ইজিবাইকে ধাক্কা দিয়ে দুজন নিহত হন।

ওই দুর্ঘটনায় আহত কাওছার বলেন, আমাদের থ্রি-হুইলারটি খুব দ্রুত গতিতে চালাচ্ছিল। আমরা চালককে বারবার নিষেধ করেছি মহাসড়কে দেখে-শুনে চালাতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় সিএনজি চালক সাইদুল আর চার বছরের এক শিশুর প্রাণ গেল।

বরিশালের নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় কথা হয় সিএনজি চালক বেলায়েত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে যে পরিমাণ মানুষ আসছে বাসে এতো সিট নেই। তাই আমরা নিতে না চাইলেও যাত্রীরাই বাধ্য করছেন।

বাকেরগঞ্জগামী আরেকটি থ্রি-হুইলারের চালক সুমন মির বলেন, সাধারণত বাকেরগঞ্জেই আমি গাড়ি চালাই। ঈদ উপলক্ষ্যে একটা লাইন করে (প্রশাসনকে ম্যানেজ করে) বরিশাল থেকে যাত্রী নিচ্ছি। বাকেরগঞ্জে জনপ্রতি ভাড়া ১০০/১২০ টাকায় নিচ্ছি।

রূপাতলী বাস টার্মিনালে কথা হয় ভান্ডারিয়াগামী যাত্রী তারিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাসে টিকেট পাইনি। তাছাড়া বাসে গাদাগাদি করে যাওয়াও কঠিন। এজন্য বেশি টাকা নিলেও থ্রি-হুইলারে করে যাচ্ছি।

রূপাতলী বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি সুলতান মাহমুদ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী থ্রি-হুইলার। শুধু ইঞ্জিন চালিত থ্রি-হুইলারই নয় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাও যাত্রী নিয়ে মহাসড়কে ছুটছে। আমরা প্রশাসনের কাছে বারবার দাবি করে আসছি মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিয়ন্ত্রিত করার। হাইকোর্টও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। মহাসড়কে পাল্লা দিয়ে থ্রি-হুইলার চলছে।

বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক উপ-কমিশনার এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, মেট্রোপলিটন এলাকার আওতায় কোথাও মহাসড়ক নেই। আমরা সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধে কাজ করছি। কিন্তু দূরপাল্লায় কেউ যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে তা বন্ধ করতে পারি না।

বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে দূরপাল্লায় যেন থ্রি-হুইলার চলাচল না করে এজন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। নির্দেশনা উপক্ষো করে দূর পাল্লায় যাত্রী নেওয়ার কথা না। তারপরও কেউ এসব কাজ করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএএ