৫৮ বছর পর একে-অন্যের হাত ছাড়লেন
শামসুল আলম ও রওশন আরা
কলেজে শিক্ষকতার সময় দেখা হয় তাদের। প্রথমে পরিচয়, এরপর বন্ধুত্ব। এক সময় তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। সেই সূত্রে বিয়ে করেন দুজন। এরপর দীর্ঘ পথচলায় কখনো একে-অন্যের হাত ছাড়েননি। যেখানেই যেতেন হাতে হাত রেখে হাঁটতেন দুজন। এভাবেই কেটেছে ভালোবাসার ৫৮টি বছর। অবশেষে মৃত্যু তাদের চার হাতকে আলাদা করে দিল।
বলছিলাম পাবনা জেলা শহরের শালগাড়িয়া মহল্লার এতিমখানা পাড়ার শামসুল আলম (৮১) ও রওশন আরা (৭৪) দম্পতির কথা। যারা ভালোবাসার বন্ধনে একে-অপরকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দিয়েছেন ৫৮ বছর। সংসারের দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানো, বাজার করা, প্রাতর্ভ্রমণ, বেড়ানোসহ সব সময় একসঙ্গে চলেছেন দুজন।
বিজ্ঞাপন
শহরের বিভিন্ন দোকানপাটে মাঝেমধ্যেই দেখা যেত তাদের। কখনো দোকানে পত্রিকা কিনতেন, কখনো মিষ্টির দোকানে বসে মিষ্টি খেতেন। আবার কখনো বাজারের ব্যাগ হাতে হাঁটতেন। চলার পথে একে-অপরের সঙ্গী ছিলেন। স্ত্রীকে বাড়িতে একা রেখে কোথাও যেতেন না। কলেজে ক্লাস নিতে গেলে মাঝেমধ্যে কলেজের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন স্ত্রী।
তবে তাদের আর একসঙ্গে দেখা যাবে না। স্ত্রীকে একা রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন শামসুল আলম। বুধবার (২৮ এপ্রিল) সকালে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। ওই দিন সন্ধ্যায় শহরের ভাঁড়ারার ঐতিহ্যবাহী শাহী মসজিদের পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন শামসুল আলম। তার মৃত্যুতে জেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা শোক জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
বাবার মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে মাহ্ফরোজী আহম্মেদ। তিনি বলেন, আমি এতিম হয়ে গেলাম। বাবা ছিলেন আমার এবং মায়ের প্রাণ ও অভিভাবক।
তিনি বলেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা গেছেন। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন।
মাহ্ফরোজী আহম্মেদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই মা-বাবাকে একসঙ্গে চলতে দেখেছি। এক মুহূর্তের জন্যও অকে-অন্যকে ছেড়ে দূরে থাকেননি। মায়ের অবস্থাও এখন খারাপ। তিনি বিছানায় পড়ে আছেন। কোনো কথা বলতে পারছেন না। ইশারায় কিছু বললে বুঝতে পারেন। বাবার মৃত্যুর পর বার বার ইশারা করে জানতে চেয়েছেন, কোথায় গেছেন, কখন আসবেন। কাফনের কাপড় পরানোর সময় দেখানোর পরও মা বুঝতে পারেননি চিরতরে একা হয়ে গেলেন।
শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি খাটের ওপর একা শুয়ে আছেন রওশন আরা। কিছুক্ষণ পরপর আশপাশে তাকান। কথা বলতে পারছেন না। তার নাতনি সুরঞ্জনা আহম্মেদ বারবার নানির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও পারলেন না। তবে ইশারা দিলে বুঝতে পারেন।
সুরঞ্জনা আহম্মেদ বলেন, নানার মৃত্যুতে নানি খুব একা হয়ে পড়েছেন। তিনি অনেক অসুস্থ। চলাফেরা করতে পারেন না। চুপচাপ থাকেন। কথাবার্তা বলেন না। খাইয়ে দিতে হয়।
শামসুল আলম পাবনা সদরের ভাঁড়ারা ইউনিয়নের ভাঁড়ারা গ্রামের এক জমিদার পরিবারে ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ভাঁড়ারা বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শুরু। পাবনা জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হন।
এরপর পাবনা সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরে ফেনীর একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে দেশসেরা হন। কিছুদিন পর খুলনা মহিলা কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১২ বছর পর পাবনার শহীদ বুলবুল কলেজে বদলি হয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।
এদিকে রওশন আরা শহরের কৃষ্ণপুর প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শেষ করে সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ডিপ্লোমা নার্স সম্পন্ন করেন। এরপর ফেনীর একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মী হিসেবে যোগ দেন। মূলত সেখানে তার সঙ্গে শামসুল আলমের পরিচয় হয়। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাজ ছেড়ে গৃহিণীর কাজ শুরু করেন রওশন।
দুজনের বাড়ি পাবনার ভাঁড়ারা ইউনিয়নের ভাঁড়ারা গ্রামে। ১৯৬২ সালে তাদের পরিচয়। ১৯৬৩ সালে বিয়ে করেন দুজন। সংসার জীবনে তাদের কখনো ঝগড়া-বিবাদ হয়নি। শামসুল আলম ভাঁড়ারা গ্রামের মজিবুল হক কিরমানির ছেলে। রওশন আরা কৃষ্ণপুর মহল্লার মৃত ডা. মোফাজ্জল আলীর মেয়ে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রওশন আরা ফেনীর একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চাকরি করতেন। সেখানে ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানে তার তিন ভাই পড়াশোনা করতেন। শামসুল আলম যে কলেজে শিক্ষকতা করতেন, সে কলেজে এইচএসসির শিক্ষার্থী ছিলেন রওশন আরার মেজো ভাই বিলাল হোসেন। সেই সুবাদে কলেজে রওশন আরার যাতায়াত ছিল।
শামসুল আলম সৌখিন মানুষ ছিলেন। বাবার হাজার বিঘা জমি থাকলেও ভোগ-বিলাসিতা তাকে স্পর্শ করেনি। বই পড়া ছিল সবচেয়ে পছন্দের। সারাক্ষণ সাহিত্য, কবিতা, খবরের কাগজ নিয়ে পড়ে থাকতেন। মাঝেমধ্যে বাসায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। মেয়ে-নাতিকে বলতেন, আমি একদিন চলে গেলে সবকিছু পড়ে থাকবে। জায়গা-জমি ভাগ করে নেবে স্বজনরা। কিন্তু জ্ঞান কেউ নিতে পারবে না। এর বাইরে তিনি কৃষিকাজ করতেন। বাড়িতে ফুল ও সবজি বাগান রয়েছে তার।
বাবার রেখে যাওয়া জায়গা-জমি ভাঁড়ারা শাহী মসজিদ, ভাঁড়ারা প্রাইমারি স্কুল, উচ্চ বিদ্যালয়, মাদরাসা ও গোরস্থানে দান করেছেন শামসুল আলম। গরিব মানুষের বসবাসের জন্য নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। বছরের পর বছর পরিবার নিয়ে তার জায়গায় বসবাস করছেন অনেকেই।
১৯৯৮ সালে কর্মজীবন শেষ করে শহরের শালগাড়িয়া এতিমখানা মোড়ে বসবাসের জন্য একটি বাড়ি করেন শামসুল আলম। এরপর কিছুদিন অতিবাহিত হলে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেন। কিছুটা একা হয়ে পড়েন রওশন আরা। তখন থেকে আর একটি বেলার জন্যও আলাদা হননি দুজন। ঘরে-বাইরের সব কাজে দুজন দুজনের সঙ্গে ছিলেন। চলার পথে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে রাখতেন।
প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম ও শরিফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শামসুল আলম ছিলেন একজন হৃদয়বান ব্যক্তি। সবসময় রসিকতা করতেন। আমাদের থাকার জন্য তিনি জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। তার জায়গায় আমরা বছরের পর বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছি। কোনোদিন তিনি কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি।
তারা জানান, এই দম্পতি ছিলেন সদালাপী। একসঙ্গে হাটে-বাজারে যেতেন। হাতে হাত ধরে চলতেন। হোটেলে একসঙ্গে খেতে বসতেন। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তারা ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
মাহ্ফরোজী আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবার মৃত্যুতে আমরা অসহায় হয়ে গেছি। বাবা আমাদের আগলে রাখতেন। আদর-স্নেহ দিয়ে সবসময় কাছে রেখেছেন। আম্মাকে কখনো চোখের আড়াল হতে দেননি। আমরা পাশে না থাকলে তিনি কান্না শুরু করে দিতেন। বাবার মধ্যে মায়া-মমতা বেশি ছিল। বাড়িঘর নিজের এলাকা ছেড়ে থাকতে পারতেন না। সেজন্য দেশসেরা একজন বিসিএস ক্যাডার হয়েও জীবনে কিছুই করতে পারেননি। শুধু বলতেন, দূরে কোথাও চাকরি করলে; তোর মা ও তোদের ছেড়ে থাকতে হবে। আমি তা পারব না।
এএম