ফেনীতে নাশকতার দুই মামলায় গ্রেপ্তার ৯৭
বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গণগ্রেপ্তারের’ অভিযোগ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ফেনীতে নাশকতার দুই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিদের মধ্যেও রয়েছে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নাম। যদিও শুরু থেকে এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করে আসছে এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা এ দলটি।
ফেনী জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, পুলিশের দায়ের করা দুই মামলায় জেলা বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ১৭ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীরা এফআইআর অন্তর্ভুক্ত নন বলে দাবি করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
বিএনপি নেতাদের দাবি, মামলায় উল্লেখিত ঘটনার সময় ফেনীতে না থেকে ও অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হলেও অনেক নেতাকর্মীকে পুলিশ নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও পুলিশ প্রশাসন যৌথভাবে জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালিয়ে শারীরিক নির্যাতন করে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আলাল উদ্দিন আলাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার এ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বিএনপি নেতাকর্মীদের গণ-গ্রেপ্তার করছে। গ্রামে গ্রামে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করছে। অনেকে অসুস্থ ও জেলার বাইরে অবস্থান করেও গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের কারো নাম মামলার এজাহারে নেই। সবমিলিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে চূড়ান্ত বর্বরতা চলছে।
বিজ্ঞাপন
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, আওয়ামী লীগ ও পুলিশ প্রশাসনের এমন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। অবিলম্বে সকল হামলা, মামলা, গুম, খুন ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। গ্রেপ্তারকৃত সকল নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সাইদুর রহমান জুয়েল বলেন, সরকার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে নিতে এখন আমাদের ওপর পড়েছে। এসব হামলা-মামলা দিয়ে নেতাকর্মীদের মনোবলে চিড় ধরাতে পারবে না।
তবে বিএনপির এমন অভিযোগ নাকচ করেছে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা। পুলিশ বলছে, নিরাপরাধ কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।
অভিযোগ ভিত্তিহীন, বলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা
ফেনীতে বিগত সময়ের ন্যায় আগামীতেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কোনো ধরনের হিংসাত্মক রাজনীতি করবে না বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। সোমবার (২৯ জুলাই) বিএনপির গণ-গ্রেপ্তার অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ঢাকা পোস্টকে এমন কথা বলেন আওয়ামী লীগের দুই নেতা।
বিএনপির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শুসেন চন্দ্র শীল ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা বা এই ধরনের কোনো কিছুরই কারণ নেই। যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে এটি স্বাভাবিক। তবে সেখানে আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের কোন নেতাকর্মীর সংশ্লিষ্টতা নেই। ফেনীতে অতীতে এই ধরনের হিংসাত্মক রাজনীতি হয়নি। আগামীতেও আওয়ামী লীগ হিংসাত্মক রাজনীতি করবে না।
জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক একে শহীদ উল্ল্যাহ খোন্দকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বা মামলা রয়েছে পুলিশ তাদেরই গ্রেপ্তার করছে। এতে আওয়ামী লীগের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও নৈরাজ্য প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ মাঠে রয়েছে। কিন্তু আমাদের জড়িয়ে বিএনপির এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
যা বলছে পুলিশ
ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) থোয়াই অংপ্রু মারমা বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নিরপরাধ কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার বা হয়রানি করছে না।
সোমবার (২৯ জুলাই) এ ব্যাপারে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ফেনী মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই (বৃহস্পতিবার) শহরের ট্রাংক রোডে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ফেনী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক আল আমিন বাদী হয়ে ২১ জনের নাম উল্লেখ ও আরও ১০০-১৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। পরবর্তী ২১ জুলাই (রোববার) আবারও সংঘর্ষের ঘটনায় উপ-পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ২৯ জনের নাম উল্লেখ ও আরও ১৫০-২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থোয়াই অংপ্রু মারমা বলেন, নাশকতার দুই মামলায় সোমবার পর্যন্ত ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তার হলেন যারা
জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ফেনীতে নাশকতার দুই মামলায় গ্রেপ্তার ফেনী বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। সোমবার (২৯ জুলাই) ফেনী পৌর যুবদলের আহবায়ক জাহিদ হোসেন বাবলু, পরশুরাম উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক জহিরুল ইসলাম, যুগ্ম আহবায়ক লোকমান হোসেন, পরশুরাম উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহবায়ক আতাউল হক মজুমদার মোহন, ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়ন বিএনপির নেতা মোহাম্মদ হানিফ, ফেনী পৌরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল নেতা আবদুল্লাহ আল কাউসার, ছাগলনাইয়া উপজেলা যুবদল নেতা আবু জাফর চৌধুরী এবং দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়ন যুবদল নেতা মুন্নাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
এর আগে রোববার (২৮ জুলাই) জেলা বিএনপি সদস্য নুরুল আমিন বাদশাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নবী মেম্বার, ধলিয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা ওমর ফারুক, ফেনী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল নেতা শামীম হোসেন, পূর্ব চন্দ্রপুর ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক আবদুর রহিম বাবলু, দাগনভূঞা উপজেলা শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল ইসলাম এবং জায়লস্কর ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মোহাম্মদ বাদশাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত শনিবার ফেনী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম মামুন ও শর্শদি ইউনিয়ন যুবদল নেতা জিয়া উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক সাপ্তাহে গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আরও রয়েছেন ফেনী জেলা বিএনপির সদস্য সাইফুর রহমান রতন, সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আমিন উদ্দিন দোলন, জেলা যুবদলের সহ-প্রচার সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন আরিফ, সদস্য ইমন, বালিগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মো. আরিফ, ছাগলনাইয়া উপজেলা যুবদল নেতা আনোয়ার হোসেন, আবুল কাশেম সোহাগ, ফুলগাজী উপজেলা ছাত্রদল নেতা মো. ইউসুফ, সোনাগাজী মঙ্গলকান্দি ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা মীর মো. আরমান, দাগনভূঞা উপজেলা যুবদল নেতা দ্বীন মোহাম্মদ দিলু, রাজাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা মো. সজিব, ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপি নেতা শেখ মো. শাহাদাতুল্লাহ, যুবদল নেতা আবদুল্লাহ আল মঞ্জু, মো. ইব্রাহিম, ফেনী সদর উপজেলার সাবেক যুবনেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো, ছাগলনাইয়া পৌরসভার যুবনেতা আবদুল কাদের, সাইফুল হক সজিব, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-সভাপতি জাহিদুল ইসলাম শিমুল, দাগনভূঞা রামনগর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা শাফায়েত হোসেন নাদিম, ফেনী পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জিয়া উদ্দিন আহাম্মেদ রতন, সোনাগাজী নবাবপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা মিনহাজুর রহমান ভূঁইয়া শাকিল, ছাগলনাইয়া মহামায়া ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আব্দুল মোমিন, ছাত্রদল নেতা আমির হোসেন ছোটন, মাতুভূঁইয়া ইউনিয়ন বিএনপি নেতা আলাউদ্দিন আলু, রাজাপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা মো. আরিফুর রহমান, জেলা যুবদলের সদস্য নুরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, রাজাপুর ইউনিয়ন যুবদল নেতা আবু তাহের কালু, সিন্দুরপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা আরিফুল ইসলাম মুন্না, জায়লষ্কর ইউনিয়ন যুবনেতা নিজাম উদ্দিন, দাগনভূঞা পৌর বিএনপি নেতা নাজমুল হক শাহীন, ফুলগাজীর আনন্দপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা আব্দুল নাহিদ, ফরহাদনগর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা আবুল খায়ের, ফুলগাজী উপজেলা যুবদল সদস্য আকবর হোসেন, ফেনী পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা আবুল কালাম, ছাগলনাইয়া পৌর ছাত্রদল নেতা মো.শাহাদাত উল্লাহ, ছাগলনাইয়া পৌর বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন, লেমুয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মিন্টু, ফেনী সদর উপজেলা মৎস্যজীবী দলের মো. ইউসুফ, পাঁচগাছিয়া ইউনিয়ন বিএনপি নেতা মোকছেদুর রহমান, ধর্মপুর ইউনিয়ন যুবদল নেতা এমরান হোসেন, সদর উপজেলা যুবদল নেতা কাজী হেলাল উদ্দিন জাহিদ, ছাত্রদল নেতা শাহাদাত হোসেন, কাজীরবাগ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন, মতিগঞ্জ ইউনিয়ন যুবদল নেতা শিপন এবং ঢাকা তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক জিল্লুর রহমান অনিক।
তারেক চৌধুরী/এসকেডি