‘মা তো মা-ই। মায়ের সাথে কারও কখনো তুলনা হয়। কোনো কিছুর বিনিময়ে মায়ের ঋণ পরিশোধ হয় না। পৃথিবীর সব মা সন্তানের জন্য বেহেশত। অন্য কারও সঙ্গে মায়ের পরম আদর-স্নেহ, মমতা-ভালোবাসার মিল হয় না। আমার মা আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই।’ মা দিবস নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় কথাগুলো বলছিলেন সংগীতশিল্পী শফিকুল ইসলাম শফি।

প্রতিবছর মা দিবসের (৯ মে) অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের মায়ের গান শোনাতেন রংপুর অঞ্চলের এই ভাওয়াইয়া শিল্পী। কিন্তু গেল দুই বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে মঞ্চ মাতাতে পারছেন না তিনি। এবারও মা দিবসে আগের মতো করে গাওয়া হচ্ছে না গান। তাই ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে তার গাওয়া জনপ্রিয় ‘মাও বড় ধন সোনারে’ গানটি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন তিনি।

গান শুরুর আগের মা দিবসের আলাপচারিতায় তিনি দু-একজন মায়ের জন্য সব মাকে ভুল বোঝাটা চরম অন্যায় বলে মন্তব্য করে বলেন, অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মা-সন্তানের সম্পর্কে টানাপোড়ন সৃষ্টি করে, তারপরও মা কখনোই সন্তানকে ভুল বোঝেন না। তবে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এখন কিছু ঘটনা ব্যথিত করে। কখনো মা মরছেন সন্তানের হাতে, আবার কখনো সন্তানকে খুন করছেন মা। এ ঘটনাগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর সব মায়ের সঙ্গে দু-একজন বিপথগামী মায়ের তুলনা করা ঠিক না। মাকে আল্লাহ মর্যাদা দিয়েছেন এবং সম্মানিত করেছেন।

এরপর সুরেলা কণ্ঠে তুলে ধরেন মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্যের কথা। গানের একেকটি উচ্চারণ থেকে সন্তানদের প্রতি মাকে কষ্ট না দিয়ে আগলে রাখার আহ্বানও জানান।

ভাওয়াইয়ার সুরেই যার পরিচিতি, তিনি শফিকুল ইসলাম শফি। তার সুর সাধনায় ভাওয়াইয়ার নতুনত্বে উত্তরের ঐহিত্য ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশে। এখন শুধু গ্রামের সহজ-সরল মানুষের মুখে নয়, ভাওয়াইয়ার ঠাঁই হয়েছে উঁচু দালানে থাকা শহুরে মানুষের কণ্ঠেও। যাদের মেধা, সুর আর অসামান্য পরিশ্রম ভাওয়াইয়াকে জাগ্রত রেখেছে, তাদেরই একজন শফি। প্রতিনিয়ত ভাওয়াইয়ার প্রচার, প্রসার, গবেষণা ও সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মকে শিখড়ের সুরে আকৃষ্ট করতে নিরলস চেষ্টায় ডুবে থাকে তার সুরেলা মন।

ভাওয়াইয়া-পাগল শফি শুধু মঞ্চে নয়, বেতার ও টেলিভিশন ছাড়াও মিউজিক ভিডিওতে সুরের মূর্ছনায় মন কেড়ে যাচ্ছেন ভাওয়াইয়াপ্রেমীদের। গ্রামেগঞ্জে, শহরে করে ঘুরে ঘুরে তুলে এনেছেন নতুন ভাওয়াইয়া শিল্পীদের। তার হাত ধরে অনেকে যেমন পরিচিতি পেয়েছে, তেমনি অর্জন করছে সুরের খ্যাতি।

সদা হাস্যোজ্জ্বল শফিকুল ইসলাম শফির ভাওয়াইয়ার হাতেখড়ি স্কুলজীবনে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ি দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া ও বিচিত্রা অনুষ্ঠানে তার প্রথম সুর বেজেছিল। বন্ধুবর এ টি এম নুর আলম লাল, মিজানুর রহমান ও বাবুলের অনুপ্রেরণা আর শিক্ষক মঙ্গল কুমার দেব, শিক্ষক আব্দুল জলিলের সাহস ও সহযোগিতায় গানের গুরু অনন্ত কুমার দেবের সান্নিধ্য পান শফি।

এরপর আর থামেনি শফির সুর। ১৯৮২ সালে শুরু হয় বাংলাদেশ বেতার রংপুর কেন্দ্রের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সবুজ মেলায় তার পরিবেশনা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুরে সমৃদ্ধ শফি এখন রংপুর বেতারের সুরকার ও সংগীত পরিচালক। বেতার তরঙ্গে তার কণ্ঠে নিয়মিত ভাওয়াইয়া শুনে থাকেন শ্রোতারা। তিনি ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।

শফি কখনো কখনো নিজেই গান লিখেছেন, আবার সুর করেছেন। ২০০৩ সাল থেকে উত্তরের মানুষের আবেগ-ভালোবাসা মিশ্রিত ভাওয়াইয়ার সুরের মিউজিক ভিডিওর নির্মাতা ও অভিনেতা এম এ মজিদের অনুপ্রেরণায় অন্তত ২৫টিরও বেশি ভিডিও অ্যালবামে কণ্ঠ দিয়েছেন শফি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘হামার রংপুর’, ‘হামার দুলাভাই’, ‘পালকি’, ‘নয়া কইনা’, ‘মেলা’, ‘হাউসের বিয়ানী’, ‘বাঁশের বাঁশি’, ‘বউ হরাইছে’, ‘নাড়িয়া নানা’, ‘রঙ্গিলা নাইয়া’, ‘রসিয়া দেওড়া’, ‘নাইওরী’, ‘রসিক ভ্রমর’, ‘ভাওয়াইয়া সুপার সেভেন (অডিও)’, ‘ভাওয়াইয়া সুপার টেন (অডিও)’সহ অনেক। তার গানের জগতে আলোড়ন সৃষ্টিতে মিউজিক ভিডিও অ্যালবামগুলো প্রশংসা
কুড়িয়েছে।

২০১৭ সালে প্রথম দেশের বাইরে ভারতের বিশিষ্ট সংগঠক বাবু মহেশ রায়ের আমন্ত্রণে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান উজানিয়া উৎসবে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথসহ আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে একে একে ৫০ বারেরও বেশি ভারতের মাটিতে পা পড়েছে তার। অর্ধশত অনুষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে ভাওয়াইয়ার সুরে মাতিয়েছেন ওপার বাংলা। পেয়েছেন উজানিয়া উৎসবে আব্বাস উদ্দিন পদক।

নিজ জেলা কুড়িগ্রামের ব্র্যান্ডিং গান ভাওয়াইয়া গাওয়ার জন্য কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাব তাকে সম্মাননা স্মারক দিয়েছে। গত বছর রংপুর রিপোর্টার্স ক্লাব থেকে তাকে আব্বাসউদ্দিন পদকে সম্মানিত করা হয়। এ ছাড়া শফির ঝুড়িতে জমা হয়েছে অনেক সম্মাননা স্মারক, পদক ও ক্রেস্ট।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শফিকুল ইসলাম শফি ১৯৭৪ সালের ৩ মার্চ কুড়িগ্রাম কাঁঠালবাড়ীর শিবরাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল হক। মা সখিনা খাতুন। মধ্যবিত্ত পরিবারের পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শিক্ষাজীবনের প্রথম সনদ অর্জন করেন কুড়িগ্রাম খলিলগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় থেকে।

১৯৯০ সালে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পাসের পর ১৯৯২ রাজারহাট মীর ইসমাইল হোসেন ডিগ্রি কলেজ এইচএসসি পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। বিএ (ডিগ্রি) পড়াশোনা করেছেন পীরগাছা সরকারি কলেজ থেকে।

বিবাহিত জীবনে শফি এক সন্তানের জনক। তার ছেলে হানজালা ইসলাম পরশ এবার উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবার মতো পরশও ভাওয়াইয়াকে তার কণ্ঠে লালন করছে। আর স্ত্রী সালমা ইসলাম শফির সুর সাধনায় পাশে থেকে ভালোবাসা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন।

বর্তমানে গুণী এই শিল্পী কুড়িগ্রাম কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং কুড়িগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীত শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ভাওয়াইয়া নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চান শফিকুল ইসলাম শফি। তার স্বপ্ন একটি ভাওয়াইয়া সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একটি ভাওয়াইয়া গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলতে চান তিনি।

এনএ