ফেনীতে বন্যায় কৃষি-মৎস্য-প্রাণিসম্পদে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে ফেনীর জনপদ। বন্যা কবলিত নিম্নাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী এলাকায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। জেলার ছয় উপজেলায় বন্যায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
জানা গেছে, টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় বন্যা কবলে পড়েছে জেলার অসংখ্য ঘরবাড়ি, গ্রামীণ সড়কসহ ফসলি জমি ও ছোট বড় পুকুর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রান্তিক জনপদের লাখো মানুষ।
বিজ্ঞাপন
জেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ থাকছে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত।
কৃষিতে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষতি
বিজ্ঞাপন
ফেনীতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। খেতে মাচান থাকলেও নেই সবুজ গাছ। পানির নিচ থেকে ভেসে উঠছে হলুদ, আদা, আউশ, আমন ও শরৎকালীন বিভিন্ন সবজি খেত। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধু কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তার মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পরশুরামের কাউতলি গ্রামের কৃষক আলী আহম্মদ বলেন, বছরের প্রথম দফায় বন্যায় আমন বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপর আবার বীজ বপন করে আমন আবাদের কিছুদিন পর বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফার বন্যায় সবগুলো ফসলি জমি এখন বালুর স্তূপ হয়ে আছে। কোনোভাবে আবাদ করে খাবো এমন পরিস্থিতিও আর নেই।
সাইদুল ইসলাম নামে আরেক কৃষক বলেন, ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছি আমরা। জমির ফসল নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঘরে থাকা ধান-চালও পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে আবাদ করার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায়, তাহলে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. একরাম উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যায় কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। আমাদের জেলা কার্যালয়ও বুক পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তারপরেও আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং তাদের নানা পরামর্শের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। কৃষকদের আমনের চারা প্রদান করার ব্যাপারে দাপ্তরিকভাবে একটি কথা উঠে এসেছে। এছাড়া এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আগাম জাতের কিছু ফসল আবাদের বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই মাসের বন্যায় ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ায় আউশ আবাদ, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আমন বীজতলা ও গ্রীষ্মকালীন মরিচের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যার পানিতে ভেসে যায় তিন উপজেলার বেশিরভাগ ফসলি জমি। তখন কৃষিতে সবমিলিয়ে ১ কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এতে ১ হাজার ৭১৯ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন।
প্রাণিসম্পদের ক্ষতি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা
ফেনীতে টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া মানুষদের আর্তি ছিল প্রাণে বাঁচা। দুর্যোগে অনেকে গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি নিয়ে আবার কেউ ফেলে রেখেই নিরাপদে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে শতশত একর চারণভূমি। পানিতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়েছে পশুপাখির দানাদার খাদ্য-ঘাস, খড়। এ অবস্থায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন কৃষক ও খামারিরা।
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, এবারের বন্যায় প্রাণিসম্পদ খাতে এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত ছিল ফুলগাজী, পরশুরাম ও ফেনী সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়। জেলার ছয় উপজেলায় ৩৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩৮ হাজার ৭৩১টি গরু, ৩৫৯টি মহিষ, ১৫ হাজার ৫৮৮টি ছাগল ও ৭৩৬টি ভেড়া মারা গেছে। এছাড়াও ২১ লাখ ৬৭ হাজার ৫১০টি মুরগি ও এক লাখ ৮৯ হাজার ৪৭২টি হাঁস মারা গেছে। মৃত পশুপাখির মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৮ কোটি ৩৬ লাখ ৩৯ হাজার ৮৩০ টাকা।
একই সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৯৬৩টি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এক হাজার ৯৯২টি গবাদিপশুর খামারের ১৩ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ২০০ টাকা এবং এক হাজার ৬২৩টি হাঁস-মুরগির খামারের ১০ কোটি ৯৭ লাখ ৫ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও ৩ হাজার ৯৫০ টন পশুপাখির দানাদার খাবার বিনষ্ট হয়েছে যার বাজারমূল্য ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। জেলায় ৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার খড়, ৩ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকার পশুপাখির ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে ২৮৫ একর চারণভূমি।
ফুলগাজীর আলমগীর হোসেন নামে এক খামারি বলেন, বন্যার ১৫ দিন আগে খামারে মুরগি নিয়েছিলাম। কোনো কিছুই সরাতে পারিনি। দেড় হাজার মুরগি, সঙ্গে খাবারসহ অন্যান্য সব জিনিসপত্র পানিতে ভেসে গেছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠা কোনোভাবেই সম্ভব না। এখন যদি স্বল্প সুদে ক্ষুদ্র ঋণের সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে অনেকে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।
আবদুর রাজ্জাক নামে এক কৃষক বলেন, তিনটি গরু লালনপালন করে কোনোমতে অভাবের সংসার সামলে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ এ বন্যায় সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। পরিবার নিয়ে একটি আশ্রয়কেন্দ্র গিয়ে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পারলেও গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি বন্যার পানিতেই রেখে যেতে হয়েছে। পানি নামার পর বাড়ি ফিরে এগুলোর আর কিছুই পাইনি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্যায় জেলার প্রাণিসম্পদ খাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৩৯৬ কোটি ৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৩ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। অনেক এলাকা এখনও পানিতে ডুবে থাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
খামারি ও কৃষকদের সহায়তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. মো. মোজাম্মেল হক বলেন, এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ওষুধ ও খাদ্য। জেলায় গত কয়েকদিনে ৫০০ কেজি খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সমন্বয় করে আমরা খামারি ও কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। এছাড়া দাপ্তরিকভাবে কোনো ধরনের প্রণোদনা অথবা সহায়তা এলে তা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করব।
মৎস্য খাতে ২৮ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি
ফেনীতে বন্যায় জেলার অধিকাংশ পুকুর ও ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। বন্যায় মৎস্য খাতে রেণু, পোনা, বড় মাছ ও পুকুরের অবকাঠামো মিলে ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বুধবার (২৮ আগস্ট) জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে জেলার ছয়টি উপজেলায় বন্যায় মাছ চাষিদের ২৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এ সংশ্লিষ্ট অন্তত ২০ হাজার মানুষ। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে একক ও যৌথ মালিকানাধীন ১৮ হাজার ৭৬০টি পুকুর-দিঘি। এসব পুকুর থেকে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বড় মাছ এবং ৯৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে গেছে। এছাড়া জেলায় খামারিদের ৫৪ লাখ টাকার অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বীরচন্দ্র নগর এলাকার মৎস্য খামারি মো. দুলাল বলেন, নদীর পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের চারপাশে নেট জাল দিয়ে ঘিরে রেখেছিলাম। কিন্তু বাঁধ ভেঙে পানির তীব্র স্রোতে এটি কোনো কাজে আসেনি। সবকিছু পানিতে ভেসে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে কোনোভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব না।
ফুলগাজীর ঘনিয়ামোড়া এলাকার মাছ চাষি হাসিবুর রহমান বলেন, অন্যান্যবারের বন্যার চেয়ে এবার পানির চাপ অনেক বেশি ছিল। মাত্র দেড়মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় বন্যার পানিতে সব ভেসে গেছে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠার আগেই বারবার লোকসান গুনতে হচ্ছে। অনেকেই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
এ ব্যাপারে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, বন্যার পানিতে অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়েছে। খামারিরা মাত্র দেড় মাসের মাথায় তৃতীয় দফার বন্যায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। তবে অন্যান্য দপ্তরের মতো মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পরামর্শ ব্যতীত কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা বা প্রণোদনার সুযোগ নেই বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত মাসের বন্যায় জেলার ফুলগাজী উপজেলায় ২৬৫টি পুকুর ভেসে সাড়ে ৪০ লাখ টাকার মাছ ও সাড়ে ৭ লাখ টাকার মাছের পোনা ভেসে যায়। উপজেলায় মাছ চাষিদের ২০ লাখ টাকার আসবাবপত্র নষ্ট হয়। সব মিলিয়ে ফুলগাজীতে ৬৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছিল। একইভাবে পরশুরাম উপজেলায় ৮০টি পুকুর ভেসে ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার মাছ ও ৩০ লাখ ৭০ হাজার টাকার মাছের পোনা ভেসে যায়। উপজেলায় মাছ চাষিদের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ টাকা। সব মিলিয়ে পরশুরামের মৎস্য খাতে প্রায় সাড়ে ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছিল।
তারেক চৌধুরী/এফআরএস