গাজীপুরের শ্রীপুরে পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) শিক্ষার্থী মুবতাছিন রহমান মাহিনের (২৩) জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। রোববার (২৪ নভেম্বর) বেলা আড়াইটার দিকে রংপুর মহানগরীর আল জামিয়াতুল করীমিয়া নুরুল উলুম মাদরাসা মাঠে জানাজা শেষে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

এর আগে রোববার ভোররাতে মাহিনের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। সেখানে নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। আদরের সন্তানকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মাহিনের মা-বাবাসহ আত্মীয়-স্বজনরা। রংপুর নগরীর জুম্মাপাড়ায় তার বাড়িতে গিয়ে এ দৃশ্য দেখা যায়।

মাহিনের আইইউটির ক্যারিয়ার অ্যান্ড বিজনেস সোসাইটির শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাবা ইমতিয়াজুর রহমান এবি ব্যাংকের সৈয়দপুর শাখার ব্যবস্থাপক। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহিন ছিলেন বড়। মা-বাবা ও পরিবারের খুব আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যে বাড়িতে আসার কথা ছিল মাহিনের। কথামতো ফিরেছেন মাহিন, তবে নিথর দেহে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর পর পরিবারের সদস্যরা কেউ ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, কেউ হাউমাউ করে কাঁদছেন, স্বজনরা শেষবারের মতো এসেছেন মাহিনকে বিদায় জানাতে। বাড়ির উঠোনে যখন মাহিনের নিথর দেহ, তখন মা নাজমুন্নাহারের বিলাপে সেখানে উপস্থিত মানুষজন কেউ কান্না লুকিয়ে রাখতে পারেননি। স্বজনদের সান্ত্বনাতেও চোখের জলে ভিজছে বুক নাজমুন্নাহারের। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো গ্রামবাসী।

মাহিনের এমন মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে তার মামা কলেজশিক্ষক জিকরুল ইসলাম বলেন, সন্তানরা কোথায় নিরাপদ? আমরা এমন মৃত্যু চাই না। আমরা এত বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছি যাতে আমাদের সন্তানরা নিরাপদ থাকে। কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা দেবে না এটা শুধু এই দেশে সম্ভব।

মাহিনের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তার ছোটবেলার বন্ধু তাসিম। জানাজা শেষে কান্নায় ভেঙে পড়া তাসিম বলেন, আন্দোলনের সময় তিন মাস একসঙ্গে ছিলাম। কিন্তু পরীক্ষা থাকায় সে ঢাকায় চলে যায়। প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে হঠাৎ সে বাড়িতে আসছিল। যাওয়ার সময় খুব তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু বন্ধু যে সারা জীবনের জন্য ফিরবে তা কল্পনাও করতে পারছি না।

মাহিনের চাচা হাসান রহমান বলেন, আইইউটি ইউনিভার্সিটিতে ক্যারিয়ার অ্যান্ড বিজনেস সোসাইটিতে শেষ বর্ষে পড়ছিল। শনিবার সকালে সে বাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে পুড়ে মারা গেছে। ছেলের মৃত্যুর খবর তার মা-বাবা সহ্য করতে পারছে না। কারণ পরিবারে সবার কাছে খুব প্রিয় ছিল মাহিন। কিছুদিন আগে তার বাড়িতে ফেরার কথা ছিল, আজকে ছেলেটি বাড়িয়ে ফিরল ঠিকই কিন্তু সবাইকে কাঁদিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, মাহিন পড়াশোনা শেষে ভালো কিছু করবে, এ স্বপ্ন আমাদের সবার ছিল। তার এমন মৃত্যু কল্পনাতেই আসছে না। তাকে ফিরতে হবে মরদেহ হয়ে এর মতো দুঃখজনক কিছু হতেই পারে না। এখানে শতভাগ একটা অবহেলা ছিল, দায়িত্বে ছিল যারা। একটা তার ঝুলে পড়বে গায়ের মধ্যে এটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই, কার অবহেলার কারণে আমাদের সন্তানকে হারাতে হলো, এমন ঘটনা ঘটল।

কাঁদতে কাঁদতে মাহিনের চাচাতো ভাই ইমতিয়াজ রহমান বলেন, সর্বশেষ দুই সপ্তাহ আগে কথা হয়েছিল। আর কথা হয়নি। অনেক ভালো ছিল মাহিন ভাই। কখনও কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করতো না। আমাদেরকে অনেক ভালোবাসত। ভাইকে অনেক মিস করব। আমার ভাইয়ের মতো যেন আর কারও মৃত্যু না হয় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি।

মাহিনের বাবা ইমতিয়াজুর রহমানও বাকরূদ্ধ। চোখ-মুখে ক্ষোভ আর দুঃখের ছাপ। বাবা হয়ে ছেলের মরদেহ কাঁধে নিতে হয়েছে তাকে। এমন অবস্থা কতটা কষ্টের তা যেন বাবারাই বোঝেন। সেই কথাটি উচ্চারণ করতে গিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে থেমে জান তিনি। তখন প্রতিবেশী হাফিজুর রহমান তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার ছেলে অত্যন্ত নম্র-ভদ্র, বিনয়ী ও মেধাবী ছিল। দেশবাসীর কাছে ছেলের জন্য দোয়া চাই। আল্লাহ যেন আমার ছেলেকে শহীদি মর্যাদা দান করেন। পরিবার যেন এ শোক কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য সবার দোয়া চাই।

শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকালে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের উদয়খালি গ্রামে তাকে বহন করা বিআরটিসির দোতলা বাসটি পৌঁছালে ঝুলে থাকা তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে মাহিনসহ আইইউটির তিন শিক্ষার্থী মারা যান। এ ঘটনায় আহত হন আরও তিনজন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে