পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে রবিউল ইসলাম

ছেলের শোকে তিন মাস আগে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন বাবা আব্দুর রহমান। আর ষাটোর্ধ্ব মায়ের অবস্থাও বেশ খারাপ। অবশেষে অবসান হলো ১৬ বছরের অপেক্ষার। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর কারাগার থেকে আলোর মুখ দেখলেন বাবা-মায়ের আদরের রবিউল ইসলাম।

যার ছেলে জেলে থাকে সেই বুঝে বুকের ধন জেলে থাকলে মায়ের কষ্ট-বেদনা। ছেলেকে কাছে পেয়ে ১৬ বছরের সকল যন্ত্রণা মুহূর্তেই ভুলে গেছেন বলে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলছিলেন পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলার আসামি তৎকালীন বিডিআর সদস্য রবিউল ইসলামের মা সালেহা খাতুন।

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিস্ফোরক মামলায় জামিনে মুক্তি পেয়েই মায়ের কোলে ফিরেছেন সাবেক বিডিআর সদস্য রবিউল। সন্তানকে কাছে পেয়ে আনন্দে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন মা, বোন, ভাইসহ পরিবারের লোকজন। হারিয়ে যাওয়া ছেলে যেন মায়ের কোলে ফিরে এসেছে- এমন আনন্দ ধরে রাখার জায়গা হয় না। দীর্ঘদিন পর রবিউলের ফিরে আসা নিয়ে আনন্দিত পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী।

শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সকালে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর ইউনিয়নের নেংটিহারা গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রবিউলের ফেরার খবর পেয়ে সকাল সকাল তার বাড়িতে ভিড় করেন আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী। বাবাহীন ঘরে বারবার কেঁদে উঠছিলেন সাবেক এই বিডিআর জওয়ান। তার এমন আহজারি দেখে পাড়া-প্রতিবেশীরাও কাঁদছিলেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ২০০৯ সালে পরিবারের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে শান্তির নীড় ছেড়ে ভবিষ্যৎ যাত্রায় বিডিআর বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) যোগ দেন রবিউল ইসলাম। চাকরিতে যোগ দেওয়ার ১৯ দিনের মাথায় ঢাকার পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রবিউলের বাবা-মায়ের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। ওই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলার আসামি হন রবিউল। সেই মামলায় তার সাজা হয়। তবে তার বাবা আব্দুর রহমানের বিশ্বাস ছিল যেহেতু ছেলে নির্দোষ, সে একদিন মুক্তি পাবেই। জায়গাজমি বিক্রি করে ছেলের মুক্তির জন্য আদালতের চত্বরে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। জেলে থাকা ছেলে ঘরে ফিরবে সেই প্রত্যাশায় দিন গুনতে থাকেন বাবা-মা। দিন যায়, মাস যায়, বছর পেরোয়, কিন্তু ছেলে আর ঘরে ফেরে না। সন্তানকে কাছে না পাওয়ার বুকভরা জ্বালা নিয়ে বাবা একসময় হারিয়ে যান চিরতরে। অবশেষে সেই ছেলে ফেরেন ঠিকই, কিন্তু বাবাহীন ঘরে।

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কয়েক দিন পর সারা দেশে পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনায় বিস্ফোরক ও হত্যা মামলার নিরপরাধ বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করেন তাদের স্বজনেরা। রবিউলের বাবাও ছেলের মুক্তির জন্য অসুস্থ শরীর নিয়ে রাস্তায় নামেন। আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তার আশা পূরণ হলেও ছেলেকে আর দেখে যেতে পারলেন না।

২০০৯ সালে প্রশিক্ষণ শেষ করে পিলখানায় বিডিআর বর্তমানে বিজিবি সদর দপ্তরে যোগ দেন। ১৯ দিনের মাথায় ঘটে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। প্রথমে একটি মামলায় ৭ বছর সাজাভোগ করে বের হন। তার কিছুদিন পর বিস্ফোরক আইনের আরেকটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠান আদালত।

স্থানীয়রা বলেন, রবিউলের চাকরি ফিরিয়ে না দেওয়া হলে তার ভবিষ্যৎ বলতে কিছুই থাকবে না। এতদিন জেলে না থাকলে হয়ত তার সুখের একটি সংসার থাকত।

রবিউলের বড় বোন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন পর ভাই ফিরে আসায় আমরা অনেক আনন্দিত। পাশাপাশি দুঃখও রয়েছে। ভাইয়ের শোকে বাবা মারা গেছেন। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল ভাই জেল থেকে বের হলে তাকে দেখবেন। বাবার শেষ ইচ্ছাটা পূরণ হয়নি।

রবিউলের মা সালেহা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলের চিন্তায় আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। তিনি বেঁচে থাকলে ছেলের মুক্তিতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতেন। ছেলের চিন্তায় আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। বর্তমান সরকারের কারণে ছেলেকে ফিরে পেয়েছি।

রবিউলের ভাই শাহজাহান আলী বলেন, আমার নির্দোষ ভাইকে বিগত সরকার জেলে রেখেছিল। ভাই এসএসসি পাস করেই চাকরিতে যোগ দেয়। এখন সরকার চাকরি ফিরিয়ে না দিলে আমার ভাই কীভাবে চলবে? তার ভবিষ্যৎ কি হবে? তাই বর্তমান সরকারের কাছে অনুরোধ, ক্ষতিপূরণসহ আমার ভাইয়ের চাকরিটা যেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

এমজেইউ