আন্তজেলা ফুটবল খেলার কথা বলে নেওয়া হয়েছিল স্কুলের মাঠ। মাঠটি টিন দিয়ে ঘেরার পর চালু করা হয়েছিল টিকিটের ব্যবস্থা। পুরুষদের খেলা চলার সময় নারী দলের খেলার ঘোষণা দেন আয়োজকরা। এতে স্থানীয় আলেম সমাজ নারীদের খেলা নিয়ে আপত্তি তোলেন। প্রথমে নারী দলের খেলার প্রচারণা বন্ধ করলেও পরে আবারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এবার স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর পর আলোচনা ছাড়াই খেলার মাঠে ঘেরা দেওয়া টিনের বেড়া ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকায় চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এ ঘটনা ঘটেছে। সেখানে বুধবার (২৯ জানুয়ারি) বিকেলে নারী ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এর আগে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে স্থানীয় কয়েকটি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও মুসল্লিরা খেলার মাঠের টিনের বেড়া ভাঙচুর করেন।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আক্কেলপুরের তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ টিন দিয়ে ঘেরাও করে ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় টি-স্টার ক্লাবের উদ্যোগে প্রায় দেড় মাস ধরে ফুটবল খেলা চলছিল। খেলা দেখার জন্য টিকিট চালু করা হয়েছিল। প্রতিটি ম্যাচে মাটিতে বসে ৩০ টাকা ও চেয়ারে বসে ৫০ থেকে ৭০ টাকা করে নেওয়া হচ্ছিল। সম্প্রতি ওই খেলার মাঠের টিনের বেড়া খুলতে গিয়ে দর্শক ও আয়োজকদের রোষানলে পড়েছিলেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মনিরা সুলতানা। এ ঘটনায় তিলকপুর ইউনিয়ন পরিষদের একজন গ্রাম পুলিশ আহত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। 

কেন এমনটা ঘটলো? 

সরেজমিনে বুধবার (২৯ জানুয়ারি) ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে আন্তজেলা ফুটবল টুর্নামেন্টে পুরুষ দলের খেলা চলার সময় নারী দলের খেলার ঘোষণা দেন আয়োজকরা। এ ঘটনায় স্থানীয় আলেম সমাজ প্রতিবাদ করে গত ২৫ ডিসেম্বর মানববন্ধন করেন। ওই দিন সেখানে এসে নারী দলের খেলা হবে না বলে আয়োজক ক্লাবের সভাপতি বক্তব্য দেন। এরপর পুরুষ দলের খেলায় ফাইনালে ওঠে জয়পুরহাটের পাকার মাথা একাদশ ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর ফুটবল দল।

ফাইনাল ম্যাচের আগে জয়পুরহাট ও রংপুর নারী ফুটবল দলের ম্যাচ আয়োজনের ঘোষণা দেয় আয়োজকরা। এরপর নারী ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন নিয়ে আপত্তি তোলেন আলেম সমাজ। বিষয়টি তারা স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে অবগত করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উভয়পক্ষকে নিয়ে বুধবার (২৯ জানুয়ারি) বেলা ১১টায় বৈঠক করার কথা ছিল। এর আগেই নারী দলের খেলার বিষয়টি মাইকিং করে এলাকায় প্রচার করেন আয়োজকরা।

মাইকিংয়ে প্রচার শোনার পর মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) আসরের নামাজের পর তিলকপুর ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির জেলা নেতা মাওলানা আব্দুস সামাদ, তিলকপুর বাচ্চাহাজী মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক, পার্শ্ববর্তী নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর ইউনিয়নের সদস্য ইয়াসিন আলীসহ স্থানীয় কয়েকটি মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এলাকার মুসল্লিরা তিলকপুর রেলস্টেশনের সামনে স্বাধীনতা চত্বরে জড়ো হন। সেখানে নারীদের খেলা নিয়ে আপত্তি তুলে কয়েকজন বক্তব্য দেন। তাদের বক্তব্য ও ভাঙচুরের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মো. মেজবাউল মণ্ডল নামে একটি আইডি থেকে লাইভ করা হয়। ২৪ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড লাইভ চালানো হয়েছে। 

ওই ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, তিলকপুরের বিভিন্ন মাদরাসাগুলোতে কোরআন শিক্ষার আদর্শ গড়ে উঠছে। আর আপনারা সেই আদর্শকে নসাৎ করার জন্য লেগেছেন। মেয়েদের লেলিয়ে দিয়ে যারা অর্থ উপার্জন করতে চান। আমি তাদের সর্তক করতে চাই। আপনারা সাবধান হোন। আগামী দিনে মেয়েদের খেলা বন্ধ করুন। যদি আপনারা বন্ধ না করেন তাহলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। এরপর সেখান থেকে স্লোগান দিতে-দিতে তারা তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে টিনের বেড়া ভাঙচুর করে। 

যা বলছেন শিক্ষক ও স্থানীয়রা

আশপাশের ধর্মভীরু লোকেরা প্রথমথেকেই এখানে নারী দলের খেলা নিয়ে বিরোধিতা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা নূর আমিন। তিনি বলেন, প্রথমে একবার হুমকি দিয়ে এটি বন্ধ করেছিল। কিন্তু আয়োজক কমিটি এটি চালানোর জন্য আবার মাইকিং করে। এটি শোনার পর আলেম সমাজের লোকজন স্টেশনের ওখানে এসে মিটিং করে সবাই যৌথভাবে এসে ভাঙচুর করে। 

স্থানীয় এক দোকানি নাজমুল হোসেন বলেন, খেলা অনেক দিন ধরেই চলছিল। মেয়েদের খেলা হবে এমন কথা শুনে এর আগে হুজুরেরা একবার কথা বলে বন্ধ করে দিয়েছিল। আবার মেয়েদের খেলা শুরু হওয়ার কথা শুনে হুজুরেরা এসে ভাঙচুর করে চলে গেছে। এখানে অনেক হুজুর এসেছিল। 

তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শরীরচর্চা শিক্ষক আজিজুল হক বলেন, বিদ্যালয়ের মাঠে যে ঘটনাটি ঘটেছে, যাদের দ্বারা ভাঙচুর হয়েছে, খেলার মাঠের চারদিকে ঘেরা টিন বা অন্যান্য কিছু ভাঙচুর করা হয়েছে, সেটির আমি নিন্দা জ্ঞাপন করছি। যদি এই খেলা বন্ধ করা দরকার ছিল, তাহলে প্রশাসনের মাধ্যমে বন্ধ করাই উত্তম ছিল। এখানে আয়োজক কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারাদেশ ও পৃথিবীতে নারীদের খেলাকে কেন্দ্র করে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। অথচ তিলকপুরে ব্যতিক্রম। আজকে তিলকপুর মাঠে খেলা বন্ধ করা হচ্ছে। অথচ তিলকপুরের বিভিন্ন জায়গায় মেলার নামে নাচ-গান, অশ্লীল নৃত্যের আয়োজন হয়। কিন্তু সেখানে বন্ধ করা হয় না। 

তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মামুনুর রশীদ বলেন, ইউএনও স্যারের মৌখিক অনুমতি পেয়ে আমি টি-স্টার ক্লাবকে খেলার অনুমতি দিয়েছি। তারা ফুটবল খেলার আয়োজন করবে। কিন্তু টিকিট করে করবে সেটি আমাদের জানা ছিল না। এটি নিয়ে বাধাও দেওয়া হয়েছে। গতকালের (মঙ্গলবার) যে ঘটনা তা আমি ফেসবুকে দেখেছি। তবে এটি কেন, তা আমি বলতে পারব না। 

নারীদের খেলা নিয়ে আপত্তি কেন?

ছেলেদের টিম চলছিল। কিন্তু মেয়েদের খেলার কথা শুনে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম বলে ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন তিলকপুর বাচ্চাহাজী মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক। 

তিনি বলেন, প্রতিবাদের পর মেয়েদের খেলার কথা বন্ধ ছিল। পরে তারা আবারও মেয়েদের খেলার বিষয়টি প্রচার করে। আমরা ইউএনওকে জানিয়েছিলাম। পরে ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও তৌহিদি জনতাসহ প্রায় ৫০০ জন সেখানে গিয়ে খেলার মাঠে ঘেরা টিন খুলে দিয়েছি। কোনো সহিংসতা হয়নি। তিলকপুরে নারীদের কোনো খেলা হয়নি। নারীরা বেপর্দা অবস্থায় খেলাধুলা করবে, এতে যুবক শ্রেণির ছেলেদের চরিত্র হরণ হবে। এই এলাকার সমাজ ভালো থাকবে না। এজন্য আমরা এটি বন্ধ করে দেওয়া চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটির জেলা নেতা মাওলানা আব্দুস সামাদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিলকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সুনাম রয়েছে। এই বিদ্যালয় মাঠ ঘেরাও করে খেলাধুলার নামে বাণিজ্য চলছে। আমাদের এমন কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু তারা বাইরে থেকে নারী ভাড়া করে এনে ফুটবল টুর্নামেন্টের ঘোষণা দেয়। এটার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এলাকার আলেমরা শুধু নয়, এলাকার শান্তিপ্রিয় জনগণ এর প্রতিবাদ জানায়। 

তিলকপুর ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা নজরুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ করে আমরা জানতে পারি মেয়েদের খেলার ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে নারী নিয়ে একটা অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, যুবকদের আকর্ষণ করা, এরই একটা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। এরপর তারা মেয়েদের খেলা ছাড়বে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তখন আমরা ফিরে আসি। দীর্ঘদিন পর তারা আবার মেয়েদের খেলা নিয়ে মাইকিং করে। এরপর আমরা আলেম সমাজ এবং এলাকাবাসী সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তুলি। যেন এখানে মেয়েদের খেলা না হয়। 

অনুমতি ছিল প্রশাসনের

জয়পুরহাট মহিলা ফুটবল ক্লাবের সভাপতি এস এম শামস মতিন বলেন, রংপুর বনাম জয়পুরহাট নারী দলের যে খেলার কথা আজ (বুধবার) ছিল। সেটি স্থগিত করায় আমাদের নারী ফুটবল টিম অংশগ্রহণ করেনি।

টি-স্টার ক্লাবের সভাপতির পদে রয়েছেন আক্কেলপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সামিউল হাসান ইমন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই মাঠে ছেলেদের খেলা হচ্ছিল। বুধবার বিকেলে জয়পুরহাট-রংপুর নারী ফুটবল দলের খেলা ছিল। আর মঙ্গলবার আসরের নামাজের পর মাদরাসার ছাত্রসহ মুসল্লিরা খেলার মাঠে হামলা চালিয়ে টিনের বেড়া ভেঙে দিয়েছে। এতে লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে সামিউল হাসান ইমনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে তিনি দেখা করতে চাননি। একপর্যায়ে তিনি মুঠোফোনে বলেন, আমাদের সবার মন খারাপ। এর আগে নারী ফুটবল দলের খেলার কথা ছিল। সেটি ওই দিনের জন্য বন্ধ করা হয়েছিল। পরে ডিসি, ইউএনওর থেকে অনুমতি নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে। আর আন্তজেলা খেলা টিকিট ছাড়া হবে না। এজন্য টাকা দিয়ে টিকিট চালু করা হয়েছিল। 

আলোচনা ছাড়াই খেলার আয়োজন

আক্কেলপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, উভয়পক্ষের মধ্যে বিরোধ হওয়ার কারণে আজ বসার কথা ছিল। কিন্তু এর আগে সেখানে একটি পক্ষ ভাঙচুর করেছে বলে জানা যায়। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনজুরুল আলম বলেন, তিলকপুরে যে অনাকাঙিক্ষত ঘটনাটি ঘটেছে। সেটি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধিতা রয়েছে। আজকে (বুধবার) দুই পক্ষকে নিয়ে বসার কথা ছিল। কিন্তু আয়োজকরা গতকাল (মঙ্গলবার) প্রচার করেছে আজকেই (বুধবার) খেলা। যার প্রেক্ষিতে একদল মুসল্লি আসরের নামাজ শেষে সেখানে আক্রমণ করে। এ ঘটনা নিয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি। দেশীয় সংস্কৃতি ও সংবিধানে কোনো ধরনের আঘাতের অভিযোগ আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এ ব্যাপারে জেলা ক্রীড়া সংস্থার আহ্বায়ক ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) আফরোজা আকতার চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারী ফুটবল খেলা ইনডোর না, এটি আউটডোর খেলা। আপনারা দেখেছেন গত কয়েকদিন নারীদের নিয়ে আমরা অনেক আয়োজন করেছি। প্রতিটি খেলা উপজেলা হয়ে জেলায় আসছে। তখন কোথাও কোনো বাধা আসেনি। আর মিটিংয়ে না বসে আয়োজকরা খেলার এমন ঘোষণা দিয়েছে। আগে বসার কথা ছিল। কারণ পোশাক, আইনশৃঙ্খলার কিছু বিষয় আছে। কিন্তু নারীদের খেলতে দেবে না, এটি মনে হয় না। আমাদের তো অনেকগুলো খেলা হলো, সেখানে ছেলেদের তো মেয়ে বানিয়ে খেলা হয়নি। মেয়েরাই খেলেছে। এখন আলেমরা নারীদের নিয়ে কোনো বক্তব্য দিলে তা আমি দেখিনি। আর আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। 

আরএআর