পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৩ মাস পর হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন সৈনিক কামরুল হাসান (৩৭)। দীর্ঘসময় কারাভোগের পর ২০১৩ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পান তিনি। তবে মামলা থেকে খালাস পেলেও কারাগারেই থাকতে হয়েছে। তিনি খালাস পাওয়ার পরও দীর্ঘ ১১ বছর কারাভোগ করেছেন। বিনা অপরাধে ১৫ বছর কারাবাসে জীবন থেকে হারিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ সময়। 

কামরুল হাসান রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌরসভার সমসাদিপুর এলাকার বাসিন্দা। পরিবারে তারা বাবা-মা ও দুই ভাই। গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) নিজ বাড়িতে কথা হয় কামরুলের সঙ্গে। তিনি বিডিআর বিদ্রোহের সময়ে নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কামরুলের পাশের সোফায় বসা তার মা-বাবাও ছেলের কষ্টের কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকেন। 

এ সময় মা সেফালী বেগম ও বাবা শাহিদুল ইসলাম বলেন, ছেলে এতো কষ্টের জীবন কাটিয়েছে, আমাদের কোনো দিন বলেনি। আমরা কষ্ট পাব বলে।

কামরুলের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী পাটকল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন কামরুল। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হন আদর্শ ডিগ্রি কলেজে। সেখানে এইচএসসি পাস করে যোগ দেন তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরে (বর্তমান নাম বিজিবি) সৈনিক হিসেবে। প্রশিক্ষণ শেষ ২০০৮ সালে যোগ দেন পিলখানায়, বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তরে। সেখানে তিনি ইলেক্ট্রিক মোকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএমই) শাখায় কর্মরত ছিলেন। যোগদানের এক বছরের মাথায় ঘটে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। ওই ঘটনার ১৩ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে তাকে হত্যা মামলায় কারাগারে যেতে হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার কেরাণীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। তার বাড়ি ফেরার আনন্দে আত্মহারা পরিবার ও আত্মী-স্বজনরা।

কামরুল বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যুক্ত হওয়ার বয়স মাত্র ১ বছর। তাই সেভাবে সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি। আমি কোন দিন দরবার হলে যায়নি। ঘটনার দিন আমি প্রথম দরবার হলে গিয়েছি। তবে দেরিতে যাওয়ায় পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেক বড় দরবার হল। তাই পেছন থেকে সামনের অফিসারদের ঠিকমতো দেখা ও চেনা যায় না। কথা শোনা তো দূরের কথা। মাইক ছাড়া কথা শোনা সম্ভব না। কিছুক্ষণ থাকার পরে হঠাৎ বিকট শব্দ কানে এলো। তখন সবই দ্রুত দরবার হল ত্যাগ করতে লাগল। তখনও আমার বুঝে আসেনি যে এখানে এগুলো কী হচ্ছে। সেখান থেকে কোনো মতে বের হয়ে দেখা হয় আমার সেকশনের একজন মেজরের সঙ্গে। তার থেকে কিছু শোনার আগেই তিনি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

তারপর দ্রুত আমার সেকশনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার সিনিয়ররা আছেন। তারা আমাদের জুনিয়র সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন- ‘তোমরা বাইরে যেও না। এখানে থাকো। ভয় পেও না। আল্লাহকে ডাকো।’ সেখানে আতঙ্কিত অবস্থায় বসে সন্ধ্যা পার করলাম। এ সময়ের মধ্যে বাড়িতে কল দিলাম। ছোট ভাইয়ের বউ রিসিভ করে। তাকে শুধু বললাম এখানে তো সমস্যা হয়েছে। সে (ছোট ভাইয়ের বউ) তখন বলল- ‘টিভিতে দেখাচ্ছে ভাইয়া।’ আমি বললাম- আমি ভালো আছি। তোমরা আমার জন্য দোয়া করো। এরপর সেদিন আর পরিবারের কারও সঙ্গে কথা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, পরদিন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল এক মিনিট মাত্র। মা তো কান্না করতে করতে বলে- ‘বাবা তুমি চলে এসো। চাকরি করা লাগবে না। বেঁচে থাকলে দিনমজুরের কাজ করে খাওয়া যাবে।’ আমি বলি- না মা, আমি সৈনিক আমি বাড়ি যাব না। এখানে আমার মত আরও সৈনিক রয়েছে। এই বলে সেখানে ছিলাম। দুই দিন কোন রকম খাবার পেটে যায়নি। পরদিন সেখান থেকে বের হয়ে সিএনজি নিয়ে বন্ধুর কাছে উঠলাম। তখন বাড়িতে কথা বলি। বাবা-মায়ের একই কথা- ‘বাবা তুমি এসো, চাকরি করার দরকার নাই। এলাকায় দিনমজুরের কাজ করে খাইও।’ তাদের কোনো রকমে বুঝালাম। যে আমি ভালো আছি। এরপর ১ তারিখে আমার কর্মস্থলে ফিরি। এমনভাবে ভালোই চলছিল। তবে মনের মধ্যে কষ্ট ছিল। যে স্যারেরা আমাদের সন্তানের মতো ভালোবাসতো তারা আজ পৃথিবীতে নেই। এমন কথা মনে আসলে খুব কষ্ট লাগত। এমনভাবে চলতে চলতে এর মধ্যে ৫ থেকে ৬ বার ছুটিতে বাড়িতে আসি। আবার ফিরে গিয়ে কাজে যোগ দেই।   

বিডিআর বিদ্রোহের ১৩ মাস পর বিপর্যয় নেমে আসে উল্লেখ করে কামরুল বলেন, সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। বিডিআর বিদ্রেহের ১৩ মাস অতিবাহিত হয়েছে। একদিন ডিউটি শেষে ক্লান্ত শরীরে রুমে শুয়ে আছি। হঠাৎ জুনিয়র একজন সৈনিক এসে আমাকে বলে- আপনাকে স্যার ডাকে। আমি বললাম- তুমি স্যারকে বলো আমি বাইরে ডিউটিতে গিয়েছিলাম। এটা বললে স্যার বুঝবে। আমি পরে স্যারের সঙ্গে দেখা করব। সে দুই পা পেছনে গিয়ে আবার এসে আমাকে বলে- ভাইয়া আপনি চলেন, আপনাকে স্যার ডাকে। আপনার নামে মামলা হয়েছে, পুলিশ অপেক্ষা করছে। সৈনিকের এই কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তখন দ্রুত উঠে স্যারের রুমে গেলাম। সেখানে আমার নাম, বাবার নাম, সৈনিক নম্বর মেলানোর পরে আমাকে জানানো হয়- সরকারি সব পোশাক রেখে আপনার লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে আসেন। আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

তখন আমি সেখান থেকে সরাসরি রুমের দিকে আসি। ততক্ষণে আমার শাখায় জানাজানি হয়ে গেছে আমার নামে মামলা হয়েছে। আমাকে পুলিশ নিতে এসেছে। এসে দেখছি সহকর্মী সৈনিকদের চোখে পানি ছলছল করছে। তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না-কাটি শুরু করে দিল। তারা বিষয়টা কোনোভাবে মেনে নিতে পারছিল না যে বিডিআর বিদ্রোহের ১৩ মাস পরে আমি আসামি হয়ে জেলে যাচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রুম থেকে এসে পুলিশের গাড়িতে উঠি। ততক্ষণে আমাকে গ্রেপ্তারের খবর বাড়িতে পৌঁছে গেছে। এরপরে হাজত বাস, তারপর রিমান্ড। ১৩ দিনের রিমান্ড শেষে জেলে। যেদিন জেলে পাঠানো হয় সেদিন বাবা-মা গিয়েছিল জেল গেটে। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনোভাবে তাদের দেখা হয়নি। কোনো কথাও হয়নি। তার কিছু দিন পরে জেলে দেখা করতে আসলে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়। যতটুকু সময় ছিল তারা সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তার বেশির ভাগ সময়জুড়ে শুধু কান্নাই করেছি। মুখে কথা আসছে না। কী থেকে কী হয়ে গেল তাদেরও (বাবা-মা) বলার ভাষা পাচ্ছি না। শুধু বলেছি তোমরা আমার জন্য দোয়া করো।

কামরুল হাসান বলেন, এরপর শুরু হয় দীর্ঘ কষ্টের জীবন। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৩ সালে আমি যে মামলার আসামি সেই মামলার রায় হয়। সেই রায়ে আমি খালাস পাই। তখন একটাই স্বপ্ন। বাড়িতে যাব, বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরব। কতই না আবেগ কাজ করেছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু খালাস পাওয়ার পরও আমাকে জেলে থাকতে হয়েছে। এর চেয়ে কষ্টের আর হতে পারে। 

তিনি বলেন, আমি কর্মরত অবস্থায় খবর পেলাম ছোট ভাইয়ের মেয়ে সন্তান হয়েছে। পরিবারে নতুন অতিথি। আর আমি বড় চাচা। আমারও তো অনেক ইচ্ছে জাগে। নতুন অতিথি বাড়িতে আসার খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার ছুটিও মঞ্জুর হয়েছে। বাড়িতে সবাই যানে বাড়িতে আসছি ভাতিজিকে দেখতে। কিন্তু তার আগেই গ্রেপ্তার হলাম। এটা আমার জীবনে আরেকটি কষ্টের গল্প।  

কামরুল বলেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় জেলের মধ্যে কেটেছে। সেই সময়গুলো অনেক কষ্টের ছিল। সেই সময়গুলো জীবনে আর ফিরে আসবে না। তবে আল্লাহকে বলতাম- আল্লাহ তুমি জানো আমার কী অপরাধ। তুমিই উত্তম ফয়সালা দিও। আল্লাহর রহমতে মুক্তি পেয়েছি। এখন আগামীর জীবন নিয়ে চিন্তায় আছি। জীবনের শেষ সময়ে এসে আমি এখন বেকার। এখন চাইলেও কোনো কাজ করতে পারব না। আমার মতো অনেক নির্দোষ, নিরপরাধ সৈনিক জেল থেকে খালাস পেয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই প্রত্যাশা, আমরা যেন আবার কর্মজীবনে ফিরে যেতে পারি।  

কামরুলের মা সেফালী বেগম বলেন, ছেলের এই অবস্থার মধ্যে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি। ভারতে চিকিৎসা চলছিল, সেখানে আমার অপারেশন হয়েছে। এতো কথা ছেলেকে জানায়নি। ভারতের হাসপাতালে অপারেশনের আগে আল্লাহকে বলেছি- আল্লাহ আমাকে জীবন ভিক্ষা দাও। আমার ছেলেকে জেল থেকে বাড়ি ফিরে যেন না শুনতে হয় যে তার মা মারা গেছে। আল্লাহ আমার ফরিয়াদ কবুল করেছেন। আমিও সুস্থ আছি। আমার বুকের মানিক বাড়িতে ফিরে এসেছে। আর কিছু চাই না। 

শাহিনুল আশিক/আরএআর