ফেনীতে থানায় আটকে রেখে যুবককে নির্যাতনের অভিযোগ
ফেনীর সোনাগাজীতে ফয়সাল হোসেন নামে এক যুবককে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে দুই দিন থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী ফয়সাল উপজেলার চরচান্দিয়া এলাকার ইস্রাফিলের ছেলে।
অভিযোগের তালিকায় রয়েছেন- সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শরীফ, পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম, স্থানীয় পিচ্চি জসিম, রুবেল, মাঈন টেইলার, সুমন ও রুবেল নামে কয়েকজন বহিরাগত।
বিজ্ঞাপন
ভুক্তভোগীর স্বজনদের অভিযোগ, ফয়সালের বাবা ইস্রাফিল ও ভোলনের সঙ্গে জেলা কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক সামছুদ্দিন খোকনের অনুসারী জামাল উদ্দিন খোকন, মো. আব্দুল্লাহ টিটু ও মো. রুবেলের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এর জের ধরে গত ২৫ জানুয়ারি রাত ৮টার দিকে সোনাগাজীর চরচান্দিয়া ইউনিয়নের পুরাতন সওদাগরহাট এলাকায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। পরে উভয়পক্ষ সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানে আবার হট্টগোল শুরু হয়। আহতদের মধ্যে চিকিৎসা নিতে আসা ফয়সালকে প্রতিপক্ষের লোকজন ঘিরে ধরে মারধর করার জন্য টানা-হেঁচড়া শুরু করেন। পরে সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের সদস্যরা এসে হাসপাতাল থেকে তাকে থানায় নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী ফয়সালের মা হাজেরা খাতুন বলেন, এসআই শরীফসহ বহিরাগত লোকজন আমার ছেলেকে থানা হেফাজতে রেখে দফায় দফায় বেধড়ক মারধর করেছে। একপর্যায়ে পায়ের নিচে ফেলে আঘাত করেছে। ২৫ জানুয়ারি (শনিবার) রাত সাড়ে ৯টায় পুলিশ ফয়সালকে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগ থেকে নিয়ে গেলেও দুই দিন পর সোমবার সকাল ১০টার দিকে আহত অবস্থায় আবার জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আমি এ ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচার চাই।
বিজ্ঞাপন
ওইদিনের হামলা, শ্লীলতাহানি ও ফয়সালকে থানায় নির্যাতনের ঘটনায় ফেনী আদালতে একটি মামলা করেছেন বলে জানান তিনি।
চরচান্দিয়ার সাবেক ইউপি সদস্য মনজুর হোসেন বলেন, গত ২৭ জানুয়ারি সকালে ফয়সালকে সোনাগাজী মডেল থানায় দেখতে গেলে কান্না করতে করতে তার ওপর নির্যাতনের কথা জানিয়েছেন। তখন ফয়সাল বলেন, রোববার দিবাগত রাত ২টার পর এসআই শরীফ তাকে মুখে কাপড় বেঁধে থানার দ্বিতীয় তলায় ওসির (তদন্ত) রুমে নিয়ে যান। সেখানে এসআই শরীফসহ বহিরাগত ৪-৫ জন লোক দফায় দফায় বেধড়ক মারধর করে। একপর্যায়ে তারা ফয়সালকে পায়ের নিচে ফেলে আঘাত করেছে। তাৎক্ষণিক আমি বিষয়টি ওসিকে জানিয়েছি। পরে ওসি চিকিৎসার জন্য ফয়সালকে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান।
মো. রুবেল নামে ভুক্তভোগী ফয়সালের এক স্বজন বলেন, থানা হেফাজতে তাকে নির্যাতনের খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম। সেখানে তার মাসহ স্বজনরা ওষুধ দিতে চাইলেও এসআই শরীফ ও বহিরাগতরা থানার গেটে দাঁড়িয়ে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। পরে আমি ওষুধ নিয়ে ভেতরে যেতে চাইলে বহিরাগত একজন আমাকে কিলঘুষি মারেন। একপর্যায়ে এসআই শরীফও চড় দিতে চাইলে আমি সরে দাঁড়াই। সেখানে অবস্থান করলে আমাকেও মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেন তিনি (এসআই শরীফ)।
সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শাহাদাত হোসেন বলেন, ২৭ জানুয়ারি পুলিশসহ রোগীর (ফয়সাল) স্বজনরা তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ব্যথা থাকায় ইনজেকশনসহ আরও অন্যান্য ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। তার পায়ে গুরুতর ব্যথা থাকায় এক্স-রে করানোর জন্য ব্যবস্থাপত্রে লিখে দিয়েছিলাম।
সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন সেন্টু বলেন, থানায় পুলিশসহ বহিরাগতদের নিয়ে ফয়সালকে মারধরের ঘটনা জানার পর পুলিশ সুপারকে অবহিত করেছি। যেখানে নিরাপদ থাকার কথা সেখানে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন জঘন্যতম ঘটনা।
যা বলছেন অভিযুক্ত দুই পুলিশ সদস্য
এদিকে এ ঘটনার পর অভিযুক্ত সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক শরীফকে ফেনী পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে শরীফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসব বিষয়ে ওসির দায়িত্ব বা কর্তব্য কতটুকু আছে সেটি আপনারাই ভালো বুঝেন। পরে এ প্রসঙ্গে তিনি মুঠোফোনে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
একইভাবে নিজ কক্ষে ফয়সালকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম।
অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশ প্রশাসন
অন্যদিকে যুবককে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে দুই দিন ধরে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ প্রশাসন। রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) রাতে ফেনীর পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বায়েজীদ আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্যাতনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
দুইদিন ধরে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, গত ২৫ জানুয়ারি সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আমরা তাকে হেফাজতে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ একটি মামলা করায় ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সোমবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। মূলত তাকে থানায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল।
তবে দুই দিন ধরে থানায় আটকে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি পুলিশের এ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ঘটনাটি ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি। ওই পুলিশ সদস্যের (এসআই শরীফ) বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
এসআই শরীফকে এ ঘটনায় সোনাগাজী মডেল থানা থেকে সরিয়ে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, এটি আমাদের তদন্তের একটি প্রক্রিয়া।
তারেক চৌধুরী/আরএআর