চেয়ারম্যানের শাশুড়িসহ সচ্ছলদের ভিজিডি কার্ড, তদন্ত কমিটি গঠন
রংপুর সদরের সদ্যপুস্করিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী সোহেল রানার বিরুদ্ধে অসহায় দুস্থদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি ভিজিডি কার্ড বিতরণে অনিয়ম ও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা তদন্তে সদর উপজেলা প্রশাসন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ওই কমিটি আগামী সোমবার (৩১ মে) তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবেন।
জানা গেছে, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে চেয়ারম্যান হতদরিদ্রদের জন্য করা ভিজিডি কার্ডের তালিকায় তার নিজের শাশুড়ি, নিকটাত্মীয়, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও ধনীর স্ত্রীর নাম দিয়েছেন। এতে করে প্রকৃত হতদরিদ্র ও দুস্থরা প্রতি মাসে সরকারের দেওয়া ভিজিডির ৩০ কেজি চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা তার পরিষদের সদস্যদের (মেম্বার) সঙ্গে নিয়ে দুই শতাধিক দুস্থদের জন্য বরাদ্দকৃত ভিজিডি কার্ড ধনীদের নামে বরাদ্দ দিয়েছেন। সেই কার্ডের তালিকায় রয়েছে চেয়ারম্যানের নিজের শাশুড়ি হাসমত আরার নাম। ২২৯ নম্বর কার্ড দেখিয়ে চেয়ারম্যানের শাশুড়ি এ পর্যন্ত চারবারে ১২০ কেজি চাল উত্তোলন করেছেন।
চেয়ারম্যান তার শাশুড়িকে ছাড়াও ৩৭৯ নম্বর কার্ডে একজন সরকারি চাকরিজীবীর স্ত্রীকেও ভিজিডির কার্ড দিয়েছেন। ৩৭৪, ৩৭৯ ও ৩৮০ নম্বর কার্ডধারীরা হচ্ছেন স্থানীয় এক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। তিনি চেয়ারম্যানের পরিবারের সদস্য এবং আর্থিকভাবে সচ্ছল। এ ছাড়া ৩২ নম্বর কার্ডে দেখা যায় পশু চিকিৎসকের স্ত্রীর নাম। ওই পশু চিকিৎসক তার স্ত্রীর নামে ভিজিডির চাল তোলেন।
বিজ্ঞাপন
ভিজিডির কার্ডে চাল উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন পশু চিকিৎসক একরামুল। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক আগে একটি চাকরিতে ছিলাম। এখন নিজের ওষুধের দোকান রয়েছে। তবে ব্যবসার অবস্থা খারাপ। এ কারণে চেয়ারম্যান সাহেবকে বলছিলাম স্ত্রীর নামে একটি ভিজিডি কার্ড করে দিতে। চেয়ারম্যান আমার কথা রেখেছেন।
হতদরিদ্র ও দুস্থ মানুষদের জন্য সরকারের ভিজিডির চাল বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়গুলো ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ উঠেছে, চেয়ারম্যান হাজী সোহেল রানা নিজের পছন্দের লোকদের খুশি রাখতে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। এ ঘটনায় সদর উপজেলা প্রশাসন তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। ওই কমিটি আগামী সোমবার (৩১ মে) তদন্ত প্রতিবেদন জমা করবেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদের তালিকায় ৮ নম্বর ভিজিডির কার্ডধারী সায়মা খাতুন ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মহিলা বিষয়ক অধিদফতর থেকে ইস্যুকৃত কার্ডে ভিজিডির চাল পাচ্ছেন। তার স্বামীর দুটো ট্রাক্টর থাকার পরও ইউপি সদস্যর মাধ্যমে তাকে একটা ভিজিডির কার্ড করে দেন চেয়ারম্যান।
তালিকায় নাম থাকা শ্রীমতি জোসনা রানী ৪ নম্বর ভিজিডি কার্ডধারী। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তার স্বামীর জমিজমা আছে। সেখানে চাষাবাদও করেন। এবার জমি থেকে ২৫ মণ ধান পেয়েছেন। তাই ভিজিডির চাল তাদের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা তাকে ভিজিডি কার্ড দেন। সেই কার্ডটি প্রতিবেশী সোবহানের কাছে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন তার স্বামী।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার দফতর সূত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নের দক্ষিণ অযোদ্ধাপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম নিসবেতগঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষকের স্ত্রী ফরিদা পারভীনের নামে ৩৬ নম্বর ভিজিডি কার্ড ইস্যু করা রয়েছে। এ ব্যাপারে স্কুলশিক্ষক তাজুল ইসলাম নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে চেয়ারম্যানের সঙ্গে আছি, সম্পর্ক ভালো। আমাদের পরিবার সোহেল রানার পক্ষে নির্বাচনে মাঠে ছিল এবং ভোট করেছি। তাই চেয়ারম্যান নিজ ইচ্ছায় একটি ভিজিডি কার্ড করে দিয়েছেন।
সার্বিক বিষয় জানতে ফোনে রংপুুুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসরাত সাদিয়া সুমির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো জনপ্রতিনিধি অথবা সরকারি কর্মচারীর নামে ভিজিডিসহ এ ধরনের কার্ড ইস্যু করার নিয়ম নেই। সদ্যপুস্করিনী ইউনিয়ন থেকে আমার কাছে অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কোনো স্বজনপ্রীতি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নাছিমা জামান ববি বলেন, যাদের ৫ শতকের ওপর জমি আছে, তারা কখনোই ভিজিডির কার্ড পাওয়ার যোগ্য নয়। এখানে চাকরিজীবী, ধনী, শিক্ষকের স্ত্রীসহ অনেককে ভিজিডির কার্ডে চাল দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। যদি এমনটা হয়, তাহলে আমি বলব এটা অন্যায়। ইউনিয়ন কমিটির যাচাই বাছাই করে তালিকা তৈরি করা উচিত ছিল।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সদ্যপুস্করিনী ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন ভিজিডির বরাদ্দ বণ্টন হয় তখন নির্বাচন চলছিল। এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এখন যা শুনেছি, মনে হয় কিছু ভুল রয়েছে। ভিজিডি কার্ডে আমার শাশুড়ির নামের তথ্যটি মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ভিজিএফের চাল চুরির অভিযোগে র্যাব-১৩ অভিযান চালিয়ে চেয়ারম্যান সোহেল রানাকে আটক করেছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। ঘটনার কিছু দিন পর ওই মামলায় জামিন পান চেয়ারম্যান সোহেল রানা।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি