চাঁপাইনবাবগঞ্জে পুলিশের সুধী সমাবেশে ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে ৫ আগস্টের সমতুল্য কামনা করা আমাদের ভুল হবে’ বলে মন্তব্য করায় জামায়াত নেতা ও ছাত্রনেতাদের তোপের মুখে পড়েছেন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। গতকাল শনিবার (২৬ এপ্রিল) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশের আয়োজিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শহীদ সার্টু হলে সুধী সমাবেশে এ ঘটনা ঘটে। 

এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোহাম্মদ শাহজাহান। সুধী সমাবেশে জেলার জামায়াত, বিএনপি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।

সুধী সমাবেশ সূত্রে জানা যায়, সুধী সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তরিকুল আলম বলেন, ‘সুধী সমাবেশে আজ বিভিন্ন বক্তব্য শুনলাম। ৫ আগস্টের জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছেলেরা লড়েছেন। আমি যে কথাটি স্মরণ করাতে চাই, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে ৫ আগস্টের সমতুল্য কামনা করা আমাদের ভুল হবে। তাই আমি অনুরোধ করে বলব ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ থেকে শুরু করে…’ কথাটি শেষ না হতেই সভাস্থলে উপস্থিত জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা প্রতিবাদ জানান। এই সময় উত্তেজিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা তরিকুল আলমের দিকে তেড়ে যান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক লতিফুর রহমান। পরে সভায় উপস্থিত থাকা অন্যরা লতিফুর রহমানকে শান্ত করেন এবং পুলিশের সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধা তরিকুল আলমের কাছ থেকে মাইক্রোফোনটি নিয়ে নিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব সাব্বির আহমেদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মিটিংয়ে তিনি আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কোনো টপিকে কথা না বলে মহান জুলাই বিপ্লবকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি সরাসরি বলেন মুক্তিযুদ্ধ আর এই কথিত বিপ্লব এক না। এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কিছু নেই। এ কথা শোনার পর পরই প্রত্যেকে বিএনপি, জামায়াত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদল সকলে উনার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। এই প্রতিবাদের তোপে একজন পুলিশ কমকর্তা তার থেকে মাইক নিয়ে নেন এবং পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত হয়। আর এ ঘটনাকে একটি গণমাধ্যম মিথ্যা নিউজে রূপান্তরিত করেছে। উনাকে মুক্তিযোদ্ধা বলে আখ্যায়িত করলেও আসলে উনি যে আওয়ামী লীগ নেতা, আওয়ামী দোসর সে কথা একবারও বলছে না। উনি এসেছিলেন আওয়ামী লীগ ও ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে। আওয়ামী লীগ প্রশ্নে আমরা সকল দলমত এক ছিলাম, থাকবো।

সভায় উপস্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সুজনের সম্পাদক মনোয়ার হোসেন জুয়েন বলেন, যখন হট্টগোল শুরু হয় তখন আমি ওয়াশরুমে ছিলাম। পরে এসে জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ এর আন্দোলন এক নয়। এতে জামায়াত নেতা লতিফুর রহমানসহ অন্যরা প্রতিবাদ জানান। তবে জামায়াত নেতা লতিফুর রহমানের প্রতিবাদটি কড়া ভাষায় ছিলো। পরবর্তীতে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক লতিফুর রহমান বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশের সুধী সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক কোন টপিকে কথা না বলে জুলাই-আগস্টের বিপ্লবকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়ায় আমরা এর প্রতিবাদ করেছি। আমরা যেমন জুলাই-আগস্টের বিপ্লবকে শ্রদ্ধা ও লালন করি তেমনিভাবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকেও লালন করি। তাই তিনি কোনভাবেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে জুলাই-আগস্টের বিপ্লবকে কটাক্ষ করতে পারেন না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খাইরুল আলম বলেন, তরিকুল আলম একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তিনি পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দালাল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া তিনি শিবগঞ্জ উপজেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সেক্রেটারি পদসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন পদ-পদবিতে আছেন। এমন বিতর্কিত ব্যাক্তি এখনো কীভাবে বিভিন্ন প্রোগ্রামে দাওয়াত পায় তা আমার বুঝে আসে না।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক সহকারী কমান্ডার মো. তরিকুল আলম বলেন, আমাকে পুলিশের পক্ষ থেকে বিকেলে ফোন করে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং পুলিশের অনুরোধেই আমি বক্তব্য শুরু করেছিলাম। কিন্তু বক্তব্য শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে ৭১ এর প্রসঙ্গ আসায় জামায়াতের নেতারা এর বিরোধিতা করে এবং আমার বক্তব্য থামিয়ে দেয়। পরে আমি সভাস্থল ত্যাগ করে চলে আসি। 

কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি বাড়িতে আছি এবং খুব ভালো আছি। আমি এমন কোনো কাজ করিনি বা কথা বলিনি যাতে কেউ হুমকি দেবে। 

দলীয় পদ-পদবির বিষয়ে তিনি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। তাকে আদর্শ হিসেবে মানি। অন্য কোনো দল করি না। আমি কোনো নেতার কাছে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেইনি এবং কোনো দলে আমার কোনো পদ-পদবি নেই। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এ.এন.এম. ওয়াসিম ফিরোজ বলেন, গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশের আয়োজনে একটি সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা বক্তব্য দেওয়া শুরু করলে জেলা জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমিরসহ অন্যরা তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। এতে একটি অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়। পরে জেলা পুলিশের তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরে অনুষ্ঠানটি আবারও চলতে থাকে। এছাড়া এরপরে প্রায় দুই ঘণ্টা অনুষ্ঠান কন্টিনিউ চলার পর ভালোভাবে শেষ হয়।

আশিক আলী/আরএআর