প্রতীকী ছবি

বরগুনায় একের পর এক সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন নারীরা। এসব ভুক্তভোগীদের মধ্যে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি। তাদের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল থেকে অথবা দূর থেকে গোপনে ছবি তুলে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য লিখে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রোফাইল, পেজ ও গ্রুপে। এতে একদিকে যেমন সামাজিকভাবে সম্মানহানি হচ্ছে ভুক্তভোগীদের, অপরদিকে পরিবারের সদস্য, সহপাঠী ও বিভিন্নজনের নানা মন্তব্যেরও শিকার হচ্ছেন তারা।

সম্প্রতি সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ফেসবুকে সার্চ করে দেখা যায়, বরগুনা উল্লেখ করে বিভিন্ন নামে অসংখ্য পেজ এবং প্রোফাইল রয়েছে। এর মধ্যে ‘শুভ মৃধা’, ‘বরগুনা ছাপরি’, ‘কট খাবি মামা’, ‘মামা বরগুনার কট ধরছি’, ‘বরগুনার ভাইরাল’, ‘বরগুনার ভাইরাল ২’, ‘বরগুনার দুষ্ট আপু গুলা’, ‘বরগুনার মধু গুলা ঔ,—এমন অসংখ্য পেজ এবং প্রোফাইলে নারীদের ছবি পোস্টসহ একের পর এক কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে আবার অনেক পেজ থেকে মেয়েদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে বিভিন্ন অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ারও অভিযোগ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এ ছাড়া তাদের দাবি কোনো একটি প্রোফাইল অথবা পেজ যদি বন্ধও হয়ে যায়, আবারও কয়েকদিনের মধ্যে নতুন নাম দিয়ে পেজ খুলে শুরু হয় একই কর্মকাণ্ড।

বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজে অধ্যায়নরত এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘটেছে এমন ঘটনা। তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ছবি সংগ্রহ করে আপত্তিকর মন্তব্য লিখে ওই ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একাধিক প্রোফাইল ও পেজে। ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগ, তিনি ছাড়াও বরগুনায় আরও একাধিক স্কুল-কলেজে পড়ুয়া তরুণীর সঙ্গেও ঘটেছে একই ঘটনা। শুধু ফেসবুক পোস্টই নয়, অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে অনেকের মেসেঞ্জারে নক করা হয় বলেও জানান ওই ভুক্তভোগী।

সাইবার বুলিংয়ের শিকার ওই শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলে আপলোড করা সিঙ্গেল ছবিগুলো গোপনে সংগ্রহ করে একটি চক্র। পরে বিভিন্ন নামে ফেক আইডি এবং পেজে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য লিখে ওই ছবিগুলো পোস্ট করা হয়। পরবর্তীতে আবার ওই পোস্টগুলোই শেয়ার করা হয় বিভিন্ন গ্রুপে। আমার প্রোফাইল থেকে ছবি নিয়ে তারা একইভাবে পোস্ট করেন। পরে আমার বাবা এবং ফুপিসহ বিভিন্ন স্বজনদের কাছে বাজে মন্তব্যসহ পোস্ট করা লিংক এবং ছবিগুলো পাঠানো হয়। এতে বাবা ও স্বজনদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে আমাকে। সত্যিই কি আমি ওই ধরনের কর্মকাণ্ড করেছি? এমন প্রশ্ন সবার। এ ছাড়া পোস্টগুলো অপরিচিত অনেকের সামনে পড়ছে, তারা না জেনেই আমাকে বাজে চোখে দেখেন। অনেক সময় কেউ কেউ বাজে মন্তব্যও করেন।

বরগুনা সরকারি কলেজের ভুক্তভোগী আরেক শিক্ষার্থী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত ছয় থেকে আট মাস ধরেই বরগুনায় বিভিন্ন নামে অসংখ্য পেজ এবং প্রোফাইল দিয়ে মেয়েদের ছবিতে খারাপ মন্তব্য লিখে পোস্ট করা হচ্ছে। ফেসবুকে বেশি ভিউ পাওয়ার জন্যও অনেকে এমন অনৈতিক পোস্ট করছেন। অনেকে আবার তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ দিয়ে তাদের প্রোফাইলেও শেয়ার করছেন। এ ছাড়া কোনো মেয়ের ব্যক্তিগত ছবি তাদের হাতে গেলেই তারা ভুক্তভোগীর সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করেন। ছবি পোস্ট না করার শর্তে অনৈতিক আবদারসহ অন্য কারো গোপন মুহূর্তের ছবি অথবা ভিডিও থাকলে তা দিতে বলেন। পরে তাদের চাওয়া পূরণ করতে না পারলেই খারাপ মন্তব্য লিখে ছবিগুলো বিভিন্ন পেজে পোস্ট করা হয়।

সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়ে সামাজিক অবস্থান ও পরিবারের বিষয়ে ভুক্তভোগী ওই শিক্ষার্থী বলেন, একজন ছেলের সঙ্গে যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে তারা সহজে বিষয়টিকে মানিয়ে নিতে পারলেও মেয়েদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। পোস্টগুলো যখন বিভিন্ন মানুষের কাছে পৌঁছায় তখন প্রতিনিয়ত তাদের খারাপ মন্তব্যও শুনতে হয় আমাদের। এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও বিনাকারণে বিভিন্ন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মেয়ের পক্ষে যা কোনোভাবেই স্বাভাবিক বিষয় নয়।

এমন হেনস্তার শিকার হয়ে প্রতিকার পেতে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গোপনে ফেক প্রোফাইল ও পেজের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়েদের ছবি পোস্ট করে হেনস্তা করছে একটি চক্র। তাদের একটি পেজ বা প্রোফাইল বন্ধ হয়ে গেলে নতুন নামে আবারও একই কাজ শুরু করেন তারা। তবে কারা এ কাজ করছে, আমরা তাদেরকে চিনতে না পারায় তাদের বিরুদ্ধে সহজে কোনো ব্যবস্থা নিতে আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে পারছি না। এ ছাড়া ভুক্তভোগী অনেক মেয়ে সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন কারণে প্রতিকারের জন্য একত্রিতও হতে পারে না।

শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মেয়েদের একের পর এক হেনস্তার ঘটনা বন্ধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে আতিকুর রহমান নামে এক সচেতন নাগরিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইদানীং বিভিন্ন মেয়েদের ছবিসহ বাজে ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে পোস্ট করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সাধারণ অনেকেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই গুজবের মতো ওই পোস্টগুলোকে শেয়ার করছেন তাদের প্রোফাইলে। এতে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পরছে ঘটনাগুলো। ফলে এমন কর্মকাণ্ডের শিকার হওয়া একটি পরিবারের সম্মানহানিসহ ভুক্তভোগী যে কারো জীবনের ঝুঁকি তৈরির একটি সম্ভাবনাও থাকে। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই।

বরগুনার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মাহিন মেহরাব অনিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের অভিযোগ দায়েরের পর জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোতে আমরা তা নিয়ে যেতে পারি না। কারণ এ বিষয়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে বরিশালে। জেলা শহর থেকে এ ট্রাইব্যুনালের দূরত্বের কারণেই অপরাধীরা অপরাধ করে বারবার পার পেয়ে যায়। অপরাধ দমনে জেলা পর্যায়ে বিচারিক কার্যক্রম চালাতে দ্রুততার সঙ্গে একজন বিচারককে নিযুক্ত করে আলাদা একটি শাখা চালুর প্রয়োজন রয়েছে। পাশাপাশি সাইবার বুলিং বন্ধে প্রত্যেকটি থানায় নারীদের জন্য আলাদা ইউনিট তৈরি করে ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বরগুনা সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি ওপেন প্লাটফর্ম।  এগুলো ব্যবহারে সবার জন্যই কিছু বিধিনিষেধ মানার প্রয়োজন রয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্য এবং সেনসেটিভ কোনো ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলে পরবর্তীতে বিভিন্ন দুষ্কৃতকারীরা ওই ওপেন থাকা তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্টদের হেনস্তা করার সুযোগ পায়। বর্তমানে বিভিন্ন প্লাটফর্মে আর্নিংয়ের সুযোগ পেয়ে পেজ বা প্রোফাইলকে ভাইরাল করতে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের পোস্ট করেন। আর এমন প্রবণতা থেকেই অনেক সময় অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে যেকোনো সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশের একটি ইউনিট কাজ করছে। যদি কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাইবার অপরাধের শিকার হয়, তাহলে দ্রুত পুলিশকে অবহিত করে লিখিত অভিযোগ দিতে আহ্বান করছি। পুলিশ এসব অপরাধ বন্ধ করতে এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে তৎপর রয়েছে বলেও জানান তিনি।

জেলা প্রতিনিধি/এএমকে