বিশ্ব মা দিবস
বাধা ডিঙিয়ে নাহিদা এখন সন্তানের ‘সাহসী’ আশ্রয়
‘পারিবারিকভাবে সর্বোচ্চ সহযোগিতা পেলেও সামাজিকভাবে সবসময় নেতিবাচক কথা শুনতে হয়। তিন বছর আগে মেয়েকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে দিয়েছি। তাকে কেন সেখানে দিয়েছি, কী পরিবর্তন দেখছি—অনেকে এমন প্রশ্নও করেন। অনেকে আবার বলেন মা-বাবার কোনো অপরাধের জন্য মেয়ে এমন অসুস্থ হয়েছেন।’—এভাবেই হতাশা ও আক্ষেপের কথাগুলো বলছিলেন ৮ বছর বয়সী বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু তাসনুভা তাবাসসুমের মা নাহিদা আক্তার।
রোববার (১১ মে) বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে নিজের সন্তানকে গড়ে তুলতে সংগ্রামী পথচলার কথা তুলে ধরেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
নাহিদা আক্তার বর্তমানে ফেনী শহরের মিজানপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তার স্বামী মো. জিয়াউদ্দিন ঢাকায় চাকরি করছেন। পরিবারে তাসনুভা তাবাসসুম ছাড়াও তার সাড়ে চার বছর বয়সী আরও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। নাহিদা আক্তার পরিবারে সন্তান জন্মদানের পর থেকে শুরু হয় সংগ্রাম। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এই সাহসী মা।
শুরুর পথচলায় নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা তুলে ধরে নাহিদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জন্মের পর বড় মেয়ে তাসনুভা তাবাসসুমের কোনো কান্নার শব্দ না পেয়ে চিকিৎসার জন্য ফেনী থেকে তখন চট্টগ্রামে নিয়ে যাই। সেখানে ১২ দিন চিকিৎসার পর সুস্থভাবে বাড়ি নিয়ে আসি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে আবারও চিকিৎসা শুরু করি। পরবর্তীতে ঢাকায় গেলে তার নানা শারীরিক সমস্যা শনাক্ত হয়। তারপর থেকে এখনো নিয়মিত চিকিৎসা চলছে।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, আমার সাড়ে চার বছর বয়সী আরেক কন্যা সন্তান রয়েছে। বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিকভাবে সে অনেক কিছু নিজে নিজে করতে পারছে। কিন্তু স্বাভাবিক শিশুদের যে উন্নতি বা বুঝ-জ্ঞান থাকে, সেদিক থেকে আমার বড় মেয়ে অনেকটা পিছিয়ে। তার আচার-আচরণে কিছুটা অস্থিরতা দেখা যায়। সাহায্য ছাড়া খাবারসহ তেমন কোনো কাজই নিজে একা করতে পারে না। এসব সামাল দিতে অনেক কষ্ট করতে হয়।
সন্তানকে গড়ে তোলার পেছনে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করে নাহিদা আক্তার বলেন, এমনিতেই আমাদের মন ছোট থাকে। অনেকে সুস্থ আরেকজন সন্তানের সঙ্গে মেয়েকে তুলনা করে কথা বলেন। তখন মন আরও খারাপ হয়। মেয়েকে নিয়ে এত কিছু কেন করছি, কী উন্নতি দেখছি—অনেকে এমন প্রশ্নও তুলেন। কিন্তু মা হিসেবে আমি সন্তানের পরিবর্তন দেখেছি। নিয়মিত এসব শুনেও না শোনার মতো করে এগিয়ে যাচ্ছি। এই পর্যায়ে সমাজ বা আশপাশের মানুষজন যদি আমাদের পাশে থেকে ভরসা দেন তাহলে কিছুটা হলেও স্বস্তি মেলে।
নাহিদা আক্তার বলেন, সমাজকে বলব আমরা মেনে নিয়েছি, আপনারাও মেনে নিন। যেসব কথায় আমরা কষ্ট পাব, তেমন কিছু করবেন না। মা-বাবা দুনিয়াতে না থাকলে এ সন্তানের কী হবে তা নিয়ে সবসময়ই মানসিক যন্ত্রণায় থাকি। কিছু সময়ের জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলেও মেয়েকে নিয়ে ভাবতে হয়।
মেয়ের উন্নতির জন্য তিন বছর আগে ভর্তি করেছেন ফেনী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ে। তবে সেখানে রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা আমাদের সন্তানদের জন্য অনেক কষ্ট করছেন। সেখানকার আওতা যদি বড় হতো বা একটি খেলার মাঠ, খেলাধুলার সরঞ্জাম থাকত তাহলে আমাদের সন্তানের জন্য আরও ভালো হতো।
ফেনী বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাকারিয়া ফারুক বলেন, ১৯৮৭ সালে শিক্ষাবিদ কামাল হাসান চৌধুরী আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে সুইড বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৯৮৮ সালে এ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১০১ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এখানে মূলত শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে কাজ করা হয়। জেলার এ প্রতিষ্ঠান বড় একটি শ্রেণির একমাত্র ভরসা। সমাজসেবা থেকেও এমন কোনো কার্যক্রম নেই। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি।
প্রসঙ্গত, ১৯১৪ সালের ৯ মে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন একটি আইন পাশ করেছিলেন। যেখানে বলা হয়েছিল মে মাসে দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালন করার কথা। তারপর থেকেই যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ এবং আরও অনেক দেশে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালন করা হয়।
তারেক চৌধুরী/আরকে