একসময় তার বিকেল কাটতো জানালার ধারে বসে। শহরের চেনা ব্যস্ততা ছেড়ে আসা এক কিশোরী পরিবারে সঙ্গে হঠাৎ গ্রামে চলে আসে। গ্রামের জীবন ছিল তার কাছে একাকিত্ব আর একঘেয়েমি। সেই একাকিত্ব কাটাতে সে শুরু করে এক সৃষ্টিশীল উদ্যোগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শখই হয়ে উঠেছে তার পরিচয়। বলছিলাম নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তানিসা তানভি ঐশীর কথা।

২০২৩ সালে রাজধানীর পিলখানার বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রব স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে ঐশী ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। ভর্তি হন ডিমলার তিস্তা কলেজে। হঠাৎ শহর থেকে গ্রামের শান্ত, ধীর জীবনে মানিয়ে নিতে গিয়ে প্রথমদিকে হতাশা গ্রাস করে তাকে। ঠিক সেই সময়েই পাশে দাঁড়ান নানি আমেনা বেগম। তার কাছ থেকেই তার ক্রাফটের হাতেখড়ি। রংতুলি আর ক্যানভাসে তৈরি করতে থাকেন নানা শিল্পকর্ম। প্রথমে নিজের শখ, পরে আশপাশের মানুষের প্রশংসায় অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু পা রাখেন উদ্যোক্তা জীবনে।

ঐশী জানান, মাত্র ৫০০ টাকা মূলধনে খুলে ছিলেন ফেসবুক পেজ-‘ইপপা’। এরপরই শুরু হয় অনলাইনে কংক্রিটের ক্রাফট বিক্রি। ধীরে ধীরে বাড়ে অর্ডার। বাড়ে পরিচিতি। এখন ঐশীর হাতে বানানো কংক্রিটের ক্রাফট শুধু দেশেই নয়, রপ্তানি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী ডিজাইন করে পাঠান তিনি। কংক্রিট দিয়ে তৈরি করেন শোপিস, ফুলদানি, মোমবাতিসহ নানা দেয়ালসজ্জার সামগ্রী। ঐশীর কাজের স্বকীয়তা, রঙের ব্যবহার ও নান্দনিকতা ক্রেতাদের এতটাই মুগ্ধ করছে যে, অনেকেই অগ্রিম বুকিং দিয়ে রাখছেন। বর্তমানে মাসে তার আয় এক লাখ টাকারও বেশি।

তবে ঐশী শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি এই সাফল্য। গ্রামের আরও ৩ থেকে ৪ জন শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুক্ত করেছেন তার কাজে। তারাও তৈরি করছেন ক্রাফট, আয় করে খরচ চালাচ্ছেন নিজেদের পড়াশোনার।

ঐশী ঢাকা পোস্টকে বলে, ঢাকায় সব বন্ধু-বান্ধব থাকায় প্রথমে এখানে এসে অনেকটা একাকিত্বের তৈরি হয়। এরপর নিজের জন্যই এসব বানাতাম। আমি প্রথমে যখন অনলাইনে ৩০০ টাকার অর্ডার পাই, তখনই সাহস বেড়ে যায়। টাকা উপার্জনের কোনো বয়স নেই। ইচ্ছা, পরিশ্রম ও আন্তরিকতা থাকলে যে কেউ কিছু করতে পারে। আমি চাই আমার চারপাশের গ্রামীণ তরুণ-তরুণীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে। বেকারত্ব দূরীকরণে নিজের জায়গা থেকে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করব।

ঐশীর বাবা তিস্তা কলেজের অধ্যক্ষ মোখলেছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়ে এসব ক্রাফটের কাজ করতে পারে জানতাম। তবে আমাদের শর্ত ছিল, পড়াশোনাটা আগে। সেটা সে মেনে চলছে।

ঐশীর মা দিলরুবা ইয়াসমিন একজন স্কুল শিক্ষিকা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়ে গোপনে এসব তৈরি করত। পরে জানতে পেরে অবাক হয়েছি। এখন আমরা ওকে সৃজনশীলতার পাশাপাশি পড়াশোনাতেও উৎসাহ দিচ্ছি। আমরা মেয়েকে ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়েছি।

স্থানীয় দাখিল মাদরাসার নবম শ্রেণির ছাত্র ইমরান হাসান ঐশীর সহকারী হিসাবে কাজ করে। এখানে কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে লেখাপড়ার খরচসহ অন্যান্য খরচ চালায় সে। ইমরান হাসান ঢাকা পোস্টকে বলে, আগে শুধু পড়াশোনা করতাম। এখন পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করি। এখানে কাজ করে আয় করে পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছি। পরিবারের কাছ চাইতে হচ্ছে না। আমিও ভবিষ্যতে এমন উদ্যোক্তা হব।

জেলা শিল্প সহায়তা কেন্দ্রের (বিসিক) কর্মকর্তা নূরেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, যদি ঐশী সহযোগিতা ও বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমাদের সাহায্য চায়, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সে আজ শুধু একজন কিশোরী উদ্যোক্তা নন, হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তার গল্প প্রমাণ করে দেয়- স্বপ্নের পেছনে সৎ সাহস আর নিষ্ঠা নিয়ে এগিয়ে গেলে, অল্প পুঁজি থেকেও গড়ে তোলা যায় সফলতার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।

শরিফুল ইসলাম/আরকে