৩৫ বছরে প্রায় ৪ হাজার লাশ কেটেছেন ডোম ভানু লাল
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে লাশ কাটার পেশায় যুক্ত রয়েছেন। কেটেছেন নারী-শিশু পুরুষসহ প্রায় ৪ হাজার মানুষের মরদেহ। বলছি ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ডোম ভানু লালের (৫৪) কথা। ঢাকা পোস্টকে তিনি জানালেন তার কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতা ও লাশ কাটা ঘরের ভেতরের অনেক অজানা ঘটনা।
জানা গেছে, বংশ পরম্পরায় ভানু লালের সাত পুরুষের পেশা লাশ কাটা। ১২ বছর বয়সে সর্বপ্রথম বাবা গনেশ লাল ডোমের সঙ্গে মরদেহ কাটা-ছেঁড়ার পেশায় হাতেখড়ি হয় তার। এরপর থেকেই তিনি পুরোদস্তুর নেমে পড়েন লাশ কাটার কাজে। ১৯৮৯ সালে ভোলা সদর হাসপাতালের ডোম পদে যোগ দেন এবং ১৯৯০ সালে তিনি সরকারি রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হন। দীর্ঘ ৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি প্রায় ৪ হাজার মানুষের মরদেহ কেটেছেন। তার রয়েছে দুই ছেলে, দুই মেয়ে, বসবাস করেন সদর পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডে।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে ভানু লাল ডোম বলেন, আমরা জাতিগত হরিজন সম্প্রদায়, আমাদের কাজই এটি। দীর্ঘ ৩৫ বছরে প্রায় ৪ হাজার মানুষের লাশ কেটেছি, ভবিষ্যতে আরও কাটব। ভোলা জেলা সদর হাসপাতালের একমাত্র ডোম আমি। জেলার ১০টি থানা থেকেই মরদেহ এখানে আসে। একা কাজ করতে হয়। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করি। লাশ কাটার যন্ত্রপাতিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে জানিয়ে তিনি বলেন, যখন যে যন্ত্রপাতি প্রয়োজন কতৃপক্ষ তা পূরণ করে।
বিজ্ঞাপন
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মেডিকেল বোর্ড রয়েছে, চিকিৎসকদের নির্দেশনা মোতাবেক লাশ কাটতে হয়। তারা যেভাবে বলেন আমি সেভাবেই লাশ কেটে হস্তান্তর করি। লাশের স্বজনরা নানান আবদার করে, কেউ কেউ বলেন লাশের প্যাকেট ভালো ভাবে করে দেবেন, আবার কেউ কেউ আবদার করে বলেন লাশের সেলাই ভালো ভাবে করে দেবেন। আসলে আমার দ্বারা যেসব কাজ করা সম্ভব আমি সেসব কাজ করে লাশের স্বজনদের মন রাখার চেষ্টা করি। অনেক স্বজন লাশ কম কাটার অনুরোধ করে। আসলে কম কাটার সুযোগ নেই, পোস্টমর্টেমের নিয়ম অনুযায়ী কাটা হয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ভানু লাল ডোম বলেন, একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে লাশের পোস্টমর্টেম করলেই লাশের শরীরের বিভিন্ন অংশ রেখে দেওয়া হয়, এটি তাদের মনগড়া মন্তব্য। পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য রিপোর্টের স্বার্থে একটা লাশের যে যে অংশটুকু প্রয়োজন চিকিৎসকের কথামতো তাই রাখা হয়।
লাশ কাটা ঘরে কখনও ভয় পেয়েছেন কি-না এবং আপনার সাথে ভয়ানক কিছু ঘটেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,অনেক অপমৃত্যুর লাশ আসে সেগুলো ভয় পাওয়ার মতো। সাধারণ মানুষ দেখলে ভয় পাবে। কিন্তু কাজ করতে করতে এখন আর ভয় পাই না। কর্তৃপক্ষ বললে রাতের ২টা বাজেও মর্গে লাশ রাখতে আসি। অনেকেই বলে লাশ কাটা ঘরে অনেক কিছুই দেখা যায়, কিন্তু আমি দেখিনি।
ভানু লাল ডোম আরও বলেন, ডোম পেশায় কর্মরত থাকায় কেউ ছোট চোখে দেখে না। ভোলাবাসীর থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। ভবিষ্যতে অগ্রাধিকার ভিক্তিতে ডোম পদটি হরিজন সম্প্রদায়কে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা যুবক আবির, রাশেদ ও রাসেল বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখছি যখনই মর্গে লাশ আনা হয়, তখন খবর পাওয়া মাত্রই তিনি চলে আসেন। আমরা দেখি যখন মর্গে লাশ আনা হয় তখন লাশের স্বজনদের মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না। লাশের স্বজনদের সঙ্গে ভানু লাল ডোম অনেক ভালো আচরণ করেন, তার এ বিষয়টি আমাদের কাছে ভালো লাগে।
ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তায়েবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভানু লাল দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মর্গে লাশের ময়নাতদন্তকালীন একজন চিকিৎসকের উপস্থিতি ও নির্দেশনায় তিনি কাজ করেন। বর্তমান আধুনিক সময়ে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য যেসব আধুনিক সরঞ্জাম তার প্রয়োজন আমরা তাকে সে সব সরঞ্জামাদি সরবারাহ করি।
খাইরুল ইসলাম/আরকে