কনস্টেবলকে মারধর করে ৩০ রাউন্ড বুলেট নিয়ে গেছে জুয়াড়িরা
মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়িতে চলমান গণেশ পাগলের মেলায় (কুম্ভমেলা) এক পুলিশ কনস্টেবলের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসময় তাকে মারধর করে ৩০ রাউন্ড শর্টগানের বুলেট ছিনতাই করে নিয়ে গেছে জুয়াড়িরা।
বৃহস্পতিবার (২৯ মে) বিকেলে ঘটনাটি ওই এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ব্যপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। তবে ছিনতাই হওয়া বুলেটগুলো এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। হামলার শিকার ওই পুলিশ কনস্টেবলের নাম মেহেদী হাসান। তিনি মাদারীপুর পুলিশ লাইন্সে নিয়োজিত আছেন। এ ঘটনায় গণেশ পাগল সেবাশ্রমের সভাপতি মিরন বিশ্বাস ও কনস্টেবল মেহেদীসহ ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বুধবার (২৮ মে) রাত ১০টা পর্যন্ত কদমবাড়ির গণেশ পাগল সেবাশ্রমের আয়োজিত কুম্ভমেলায় ডিউটি করেন পুলিশ কনস্টেবল মেহেদী। পরে বৃহস্পতিবার (২৯ মে) ভোররাত ৪ টার দিকে তিনি সিভিল পোশাকে মেলার মাঠের জুয়ার আসরে যান। এসময় জুয়ারিদের সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে তার সাথে থাকা সরকারি শর্টগানের ৩০ রাউন্ড বুলেট নিয়ে পালিয়ে যায় জুয়াড়িরা।
বৃহস্পতিবার রাতে সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কুম্ভমেলা বা গণেশ পাগলের মেলার মূল মাঠের মধ্যেই বসেছে সারি সারি জুয়ার আসর। প্রায় ২০টি জুয়ার আসরে চলছে রমরমা জুয়া খেলা। বড় জুয়ার আসরের কোট বানানো হয়েছে বিভিন্ন মডেলদের ছবি দিয়ে। আর ছোট জুয়ার কোট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে চরকি। প্রতিটি জুয়ার আসর ৫-৬ জন করে পরিচালনা করছেন। মুহূর্তেই টাকায় হাত ভরে যাচ্ছে জুয়ার আসর পরিচালকদের। একই সাথে নিঃস্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তবে এসময় সাংবাদিকদের ক্যামেরা দেখে কয়েকটি জুয়ার আসর ফেলে রেখে পালিয়ে যায় জুয়াড়িরা।
বিজ্ঞাপন
অপরদিকে কালী মন্দিরে প্রকাশ্যে চলে গাঁজা সেবন ও বিক্রি কার্যক্রম। সেখানে সুব্যবস্থাপনায় শত শত মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীরা একত্রে বসে গাজা সেবন করছেন। তবে সকলের জন্য মাদক সেবন ও বিক্রি দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও ওখানে আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিকরা
মেলার মাঠে জুয়ার আসর পরিচালনাকারী মাসুদ নামে এক জুয়ারি বলেন, জুয়ার খোটের বিষয় সব কমিটির (গণেশ পাগল সেবাশ্রম কমিটি) লোকজন জানে, আমি কিছু জানি না। আমাকে ২ হাজার টাকা বেতনে কাজ করাইতেছে।
কালিপদ নামে আরেক জুয়াড়ি বলেন, এই জুয়ার আসরটা প্রসাদ মেম্বার বসাইছে। সে কদমবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান ইউপি সদস্য। আমি শুধু দাড়াই আছি। কিছু বলি নাই।
এ ব্যাপারে কদমবাড়ি গণেশ পাগল সেবাশ্রমের সভাপতি মিরন বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, জুয়ার আসর বসার ব্যাপারে কমিটি কিছু জানে না। আমরা যতবার যেনেছি পুলিশের মাধ্যমে ভেঙে দিয়েছি।
তবে প্রকাশ্যে গাজা সেবনের বিষয় জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এটা বলা যাবে না। তবে লালনের মাজারে যেমন চলে, এখানেও তেমনই চলে। এটা প্রশাসনও জানে। আমরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি, কিন্তু প্রশাসন পারে নাই। এখন আমরা কি করবো!
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ কনস্টেবলের ওপর হামলার ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঘটনাস্থালে আছি। জুয়া খেলা ও গাজা সেবনের বিষয়টি যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি। অসংখ্য লোক, এ কারণে কন্ট্রোল করা একটু টাফ। তারপরও আমাদের লেভেল থেকে এটা জিরো টলারেন্স।
প্রসঙ্গত, বুধবার (২৮ মে) সকাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কদমবাড়িতে শুরু হয় প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কুম্ভমেলা বা গণেশ পাগলের মেলা যা স্থানীয়ভাবে কামনার মেলা নামেও পরিচিত। আগামী শনিবার (৩১ মে) পর্যন্ত ৪ দিনব্যাপী এ মেলা চলবে। মহামানব শ্রী শ্রী গণেশ পাগলের স্মরণে আয়োজিত এই ধর্মীয় উৎসবে দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তরা আসেন। এ মেলাকে কেন্দ্র করে সহস্রাধিক ছোট বড় বিভিন্ন দোকান বসেছে। প্রতি বছর ১৫ লাখ লোকের সমাগম ঘটে এ মেলায় বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটি।
এর আগে মঙ্গলবার (২৭ মে) রাত থেকেই দলে দলে জয় ডংকা ও নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জয় হরিবল ও জয়বাবা গণেশ পাগল ধ্বণি করতে করতে দেশের বিভিন্নস্থান থেকে সাধু সন্নাসী ও ভক্তবৃন্দরা বাসে, ট্রাকে, ট্রলারে ও পদব্রজে মেলা প্রাঙ্গণে আসতে শুরু করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শত বছর ধরে মাদারীপুর রাজৈরের কদবাড়ির দিঘীরপাড় এলাকার মহামানব শ্রী শ্রী গণেশ পাগল সেবাশ্রমে দেশের ঐতিহ্যবাহী এই কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। হিন্দু ধর্মাম্বলীদের শাস্ত্রমতে সত্য যুগে দেবতা ও অসুরদের মধ্যে সমুদ্র মন্থনে যে অমৃত সুধা উঠেছিল তা চারটি কুম্ভ পাত্রে হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী ও নাসিক এ চারটি স্থানে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনার পর থেকে ভারতীয় মুনি ঋষিরা কুম্ভ মেলার আয়োজন করে আসছেন। শত বছর আগে জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখে ১৩ জন সাধু ১৩ সের চাল ও ১৩ টাকা নিয়ে রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ীর দীঘিরপাড় এলাকায় ভারতের কুম্ভমেলাকে অনুসরণ করে এ মেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে এখানে মহামানব শ্রী শ্রী গণেশ পাগল সেবাশ্রমে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মূল মেলা হয় এক রাতের জন্য। তবে এই মেলা চার দিন চলবে। কখনও কখনও সপ্তাহ ব্যাপীও হয়ে থাকে। এখানে বিভিন্ন দেবদেবতার ১০৮টি মন্দির রয়েছে।
আকাশ আহম্মেদ সোহেল/এমএএস