রাস্তায় পড়ে থাকা জুলেখাকে বাড়ি ফেরাল ‘পারি’
মানসিক ভারসাম্যহীন জুলেখা অবহেলা-অযত্নে রাস্তায় পড়ে ছিলেন দিনের পর দিন। কেউ ফিরেও তাকায়নি। পরে ‘পারি ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক দল এ অবস্থা দেখে উদ্ধার করে তার সেবা-যত্ন-চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। উত্তরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। এরপর অক্লান্ত চেষ্টায় তার ঠিকানা সংগ্রহ করে পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন সংগঠনের সদস্যরা।
এমনই এক ঘটনা ঘটেছে গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার বরিশাল ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, ১৫ বছর আগে জুলেখা সুলতানাকে (৫০) তালাক দেন তার স্বামী। এ নিয়ে সালিস বৈঠক হয়। বৈঠকে তার কোল থেকে কেড়ে নেওয়া হয় একমাত্র সন্তান শাহানাজকে। তখন থেকেই তার আশ্রয় হয় বাবার বাড়িতে। সেই থেকে নানা চিন্তাভাবনায় স্বামী ও সন্তানের শোকে অনেকটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন জুলেখা।
আট মাস আগে হঠাৎ বাবার বাড়ি রামপুর গ্রাম থেকে হারিয়ে যান জুলেখা। পরিবারের সদস্যরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয় স্থানীয় বাস কন্ডাক্টরের মাধ্যমে জানতে পারেন, জুলেখা ঢাকায় গিয়েছেন। পরে ঢাকায় বসবাস করা জুলেখার ছোট বোন ও তার স্বামী বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও দেখা পাননি তার। একসময় জুলেখাকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দেয় তার পরিবার।
একদিন পারি ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজের ভিডিওতে জুলেখার উত্তরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হওয়ার খবর দেখতে পান রামপুর গ্রামের স্থানীয় কয়েকজন যুবক। তারা জুলেখার পরিবারকে খবর দিলে ভিডিও দেখে মা জামিলা বেগম নিশ্চিত করেন, এটিই তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে জুলেখা। পরে পারি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফিরে পান জুলেখাকে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে, পলাশবাড়ির রামপুর গ্রামের বাবার বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় জুলেখার সঙ্গে। বাড়িতে উঠানে বসে আছেন তিনি। কোমরের পান পাশের জয়েন্টে অস্ত্রোপচার হওয়ায় নিজে একা চলতে পারেন না। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও অন্তত দুজনের সাহায্য নিতে হয়। এদিকে জুলেখার বাবাও পঙ্গু। বাড়িতে সচল লোক বলতে একমাত্র তার মা জামিলা বেগম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারও কোমরের হাড়ও ক্ষয়ে গিয়েছে। অনেক কষ্ট করে স্বামী ও মেয়ের দেখাশোনা করেন।
জমিলা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আট মাস আগে জুলেখা বাড়ি থেকে হারিয়ে যায়। স্থানীয় বাস কন্ডাক্টরের মাধ্যমে জানি সে ঢাকায় আছে। সেখানে থাকা অবস্থায় দুর্ঘটনায় কোমরের অংশ ভেঙে যায় জুলেখার। পঙ্গু হয়ে বাস্তার পাশে ফুটপাতে আশ্রয় হয় জুলেখার। খেয়ে না খেয়ে বিনা চিকিৎসায় দিন কাটে মাসের পর মাস। পরে পারি ফাউন্ডেশনের একজনের মাধ্যমে তাকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অপারেশন শেষে তাদের একটি ভিডিও দেখে আমার মেয়ে জুলেখাকে পেয়েছি।
জমিলা পারি ফাউন্ডেশনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আমার নিজে চলতেই কষ্ট হয়। কোমরের হাড় ক্ষয় গিয়েছে। তা ছাড়া স্বামী পঙ্গু। জুলেখা তো অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতেই পারে না। মাসে মাসে ছোট মেয়ের দেওয়া সামান্য কিছু টাকায় কোনোমতে চলছে সংসার। তিনি সমাজের বিত্তবানদের এই অসহায় পরিবারটির পাশে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
জুলেখার বাবা গোফফার মিয়া বলেন, আমি পল্লিচিকিৎসক ছিলাম। প্যারালাইসিস হয়ে পঙ্গু হয়েছি। সংসারের কোনো আয় নেই। মেয়েটাও পঙ্গু হলো। এখন কী হবে ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের বাবা-মেয়ের জন্য দুইটা হুইলচেয়ার হলে আমরা একটু অন্তত নিজে চলতে পারতাম।
জুলেখার প্রতিবেশী তহমিনা, রিমা, ফেন্সি বেওয়াসহ কয়েকজন জানান, পরিবারটি খুবই অসহায়। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে তাদের। উপার্জনক্ষম কোনো লোক নেই। সরকারি বা বেসরকারিভাবে দুইটা হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করা হলে তাদের জন্য সামান্য হলেও একটু উপকার হতো।
পারি ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি ডা. ফয়সাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানসিক ভারসাম্যহীন জুলেখা অবহেলা-অযত্নে পথেই পড়ে ছিলেন দিনের পর দিন, কেউ ফিরেও তাকায়নি। পারি ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক দল এ অবস্থা দেখে তার সেবা-যত্ন-চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। এরপর অক্লান্ত চেষ্টায় তার পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে পারি ফাউন্ডেশন। রাস্তায় পড়ে থাকা পরিচয়হীন এক নারীকে মায়ের মতো সম্মান দেওয়া, সেবা দেওয়া আর পরিবারের সঙ্গে মানুষটির সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়ার তুলনাহীন তৃপ্তিটুকুই পারি পরিবারের জন্য অমূল্য প্রাপ্তি।
তিনি বলেন, পারি ফাউন্ডেশন সর্বদা এসব অসহায় ভাসমান ভারসাম্যহীন মানুষদের নিয়ে কাজ করে। প্রতি শুক্রবার এক বেলা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের খাবার, ২ টাকায় চিকিৎসাসেবা, বিয়ে প্রোগ্রামে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট খাবার সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে তুলে দেওয়া, সেচ্ছায় রক্তদান ছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন করে। আমরা সমাজের বিত্তশালী ও গণমাধ্যমের একান্ত সহযোগিতা কামনা করছি।
এনএ