‘নদীতে ইলিশ নাই ভাই। আর সব মাছও এক্কেরে কম। সংসারতো চালাইতে হইবে, এই জন্য রেণু ধরি।’

মেঘনা নদীতে চারগড়া জাল টানতে টানতে কথাগুলো বলছিলেন রফিজল মাঝি। কিছুক্ষণ পরপর জাল তুলে চা চামচ আর ঝিনুক ভাঙা দিয়ে রেণু বাছাই করে পানিভরতি পাত্রে আলাদা করে রাখেন। জালে উঠে আসা অন্য মাছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোনা, জলজ প্রাণী আর জলজ উদ্ধৃত ছুড়ে ফেলেন তীরে, শুকনো জমিতে।

রফিজল মাঝি বলেন, দুই তিন মাস নদীতে অনেক রেণু পাওয়া যাচ্ছে। এক টাকা দরে বিক্রি করতে পারি। দিনে পাঁচ থেকে সাতশ টাকা রোজগার হয়।

প্রশ্ন করলে বলেন, আমাদের কি করার? পেটের ক্ষুধাতো নিয়ম-নীতি মানে না।

অথচ রফিজল জানেন রেণু শিকার আইনত দণ্ডনীয়। মৎস্য অফিস জানিয়েছে, চিংড়ির সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত রেণু আহরণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। রেণু পাচার রোধে মৎস্য দপ্তর ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন ভূমিকা রাখেন। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে চিংড়ির রেণু সংগ্রহ বন্ধে আদেশ জারি করেছিল সরকার। এরপর থেকেই নানান তৎপরতায় রেণু সংরক্ষণের কথা বলা হয়। তবে বৈশাখ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের নদীগুলোতে ছোট ছোট জাল দিয়ে রেণু শিকার করতে দেখা যায়। রেণু শিকারে চরগড়া, বেহুন্দি, মশারি ও নেট ব্যবহার করা হয়। এসব জাল এতটাই সুক্ষ্ণ যে অতিক্ষুদ্র জলজ প্রাণীও বের হতে পারে না। এমনকি রেণু পাচারে এলাকায় এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে সিন্ডিকেট।

একই সুরে কথা বললেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার কচুবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ আলী। তিনি বলেন, নদীতে কম এখন সাগরে মাছ বেশি। আমি সাগরে যাই না। মাঝেমধ্যে রেণু ধরি। আমি রেণু না ধরলে আর কাউকে দিয়ে ঠিকই ধরিয়ে নিবে।

কারা রেণু শিকার করান প্রশ্নের জবাবে বলেন, য্যাগো ক্ষমতা আছে হেরা। আগে য্যারা ক্ষমতায় আছিল হ্যারা ধরাইতো, এহন য্যারা ক্ষমতায় তারা আবার ধরায়।

মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের করা জরিপে দেখা গেছে, একটি রেণু শিকার করতে গিয়ে ৩৮ প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও ছয় প্রজাতির অন্যান্য মাছ এবং ৫৬ প্রজাতির জুপ্লাংটনসহ ১০০ প্রজাতির জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে এ জরিপ চালানো হয়। এরপরই সরকার রেণু শিকার বন্ধে পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ ইতোমধ্যে রেণু শিকারে জড়িয়ে পড়েছে।

রেণু শিকার প্রবণ নদীসমূহ 

বরিশাল বিভাগের প্রায়সবগুলো নদীতেই বর্ষা মৌসুমে রেণু পাওয়া যায়। এরমধ্যে জেলা ভিত্তিক কয়েকটি নদীতে অধিক হারে রেণু মেলে। যেমন ভোলার সাতটি উপজেলা ঘিরে রাখা মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী। বরিশাল জেলার হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা সংলগ্ন মেঘনা, সদর উপজেলা সংলগ্ন তেঁতুলিয়া, কীর্তনখোলা, বাবুগঞ্জের আড়িয়াল খাঁ, বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা, বাকেরগঞ্জ উপজেলার তুলাতলি, কারখানা, তেতুলিয়া, বিষখালী, পায়রা নদী। পিরোজপুর জেলার কঁচা, বলেশ্বর, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা ও পোনা নদী। পটুয়াখালী জেলার বুড়াগৌরঙ্গ, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক, কুয়াকাটা সৈকত সংলগ্ন সমুদ্র। বরগুনা জেলার বলেশ্বর-বিশখালী আর পায়রা নদী মোহনার বিভিন্ন এলাকায়। এরমধ্যে বরগুনা সদর উপজেলার কুমিরমারা, নিশানবাড়িয়া, গোলবুনিয়া ও চালিতাতলি, পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা স্লুইজ, রুহিতা এবং তালতলী উপজেলার জয়ালভাঙ্গা, নিশানবাড়িয়া, নিদ্রা সখিনা। ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা, বিশখালী, গাবখান চ্যানেল, গজালিয়া নদীতে রেণু শিকার করতে দেখা যায়।

বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলা, পটুয়াখালীতে শিকার করা রেণু বরিশাল রুটে পাচার করা হয়। এছাড়া পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠিতে শিকার করা রেণু পিরোজপুর হয়ে খুলনা রুটে পাচার করা হয়।

পাথরঘাটার রেণু শিকারি হাকিম বলেন, লোকজন যেসব এলাকায় কম যায় সেসব এলাকায় জাল টেনে রেণু ধরি। সাধারণত এক হাজার রেণু ৮/৯শ টাকায় বিক্রি করি। শুনছি সেই রেণু খুলনা সাতক্ষীরা গিয়ে বিক্রি হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। মনে করেন, সারাদিন জাল টেনে রেণু জমিয়ে রাখি। সন্ধ্যার পর বা মাঝরাতে বড় ব্যবসায়ীরা এসে নিয়ে যায়।  

রেণু ক্রেতা কারা?

স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে সাধারণত রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা জেলেদের অনুপ্রাণিত করে রেণু শিকারে। বিশেষ করে উপকূলের বাজারের মৎস্য আড়ৎদারেরা বর্ষা মৌসুমে দাদন দিয়েও নদীতে জেলেদের পাঠায়। রেণু শিকারে প্রাপ্ত বয়স্কদের পাশাপাশি শিশু ও নারীদের ব্যবহার করা হয়।

পটুয়াখালী জেলা মৎস কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর আগেও পটুয়াখালীর বিভিন্ন নদীতে এবং কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগরে রেণু শিকার হতো নির্দিধায়। তবে মৎস অফিস স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে অনেকাংশে কমিয়ে এনেছে। রেণু শিকার করতে শিশু ও নারীদের ব্যবহার করা হলেও এই ব্যবসাটির পেছনে অনেক আড়ৎ বা গদি জড়িত। এজন্য আমরা গদিগুলোকে নজরদারিতে রেখেছি। বিভিন্ন সময়ে অসাধু এইসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। সেই প্রক্রিয়া এখনো চলমান।

ভোলা ক্ষুদ্র ও মৎস্যজীবী জেলে সমিতির সাধারণ সম্পাদক এরশাদ ফরাজি বলেন, দুইমাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে কাঙ্খিত মাছ না পাওয়ায় জেলেরা অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিন পার করছেন। রেনু ধরে কিছুটা অভাব দূর করতে চাইছেন তারা। আমি মনে করি সরকারি ভাবে জেলেদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনলে বড় ক্ষতি থেকে আমরা রক্ষা পাবো।

যা বলছে মৎস্য অধিদপ্তর

রেণু শিকার রোধে মৎস্য অফিসগুলো কাজ করলেও লোকবল সংকট, তথ্যের ঘাটতির কারণে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পিরোজপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সঞ্জীব সন্ন্যামত। তিনি বলেন, রেণু শিকার করে দেশের মধ্যেই মৎস খামারে বিক্রি করা হয়। সাধারণত এই অঞ্চলের রেণু খুলনা-সাতক্ষীরার ঘেরে যায়। মূল সমস্যা হচ্ছে একটি রেণু ধরতে গিয়ে অন্যান্য শতাধিক প্রজাতির মৎসবীজ মেরে ফেলে জেলেরা। অন্য মৎস্যবীজ বাঁচিয়ে রাখতে পারলে সমস্যা হতো না।

তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে পটুয়াখালী, ভোলা উপকূলে বেশি রেণু শিকার হয়। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া সংলগ্ন কয়েকটি নদীতে অল্প পরিসরে হতে পারে। তাও আমরা কমিয়ে আনছি। প্রকৃতপক্ষে পিরোজপুরকে রেণু পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এজন্য আমরা বিভিন্ন গাড়ি থেকে পাচারের সময় রেণু উদ্ধার করে নদীতে ছেড়ে দেই।

ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব বলেন,  কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা জেলেদের দিয়ে চিংড়ির রেণু শিকারে প্ররোরিচত করছে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এ বছর এমন আটজন ব্যবসায়ীকে আটক করে নিয়মিত মামলা দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি রেণু চিংড়ি আহরণ বন্ধ করতে।

মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক আলফাজ উদ্দীন শেখ বলেন, নদীতে চিংড়ির রেণু যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি। সাধারণত রেণু শিকারীদের ৯০ শতাংশ নারী ও শিশু। তাদের ক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়ন করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও অভিযান পরিচালনা করে আহরিত চিংড়ি রেণু আটক করে ফের নদীতে অবমুক্ত করছি।

তিনি বলেন, রেণু শিকার করতে গিয়ে অন্য শতাধিক মাছের পোনা মেরে ফেলে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয় প্রতি বছর। যে কারনে নদীতে তুলনামূলক মাছ কমে যাচ্ছে। রেণু শিকারে সাধারণত স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা জড়িত থাকেন। যেসব গদি দিয়ে এসব পাচার হয় তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করছি। পাশাপাশি জেলেদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেকাংশে ইতোমধ্যে সফলতা এসেছে। মৎস দপ্তর চেষ্টা করছে চিংড়ির রেণু শিকার বন্ধে শতভাগ সফলতার।

আরকে