৫ আগস্টের সকাল। সূর্যের আলোয় লেগেছিল অনিশ্চয়তার ধূসর ছাপ। বাতাস ভরে উঠেছিল প্রতিবাদের উত্তাপে। রাস্তায় নেমেছিল স্বপ্নের মিছিল-হাতে পোস্টার, কপালে পতাকা, কণ্ঠে সমতার গান। রাষ্ট্র তার জবাব দেয় বারুদের গন্ধে, গুলির শব্দে।

রাজধানীর আদাবর এলাকা রূপ নেয় রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে। একটি বুলেটের আঘাতে সেখানেই থেমে যায় রুবেল ইসলাম নামে ১৯ বছর বয়সী এক হাসিমুখী স্বপ্নচারীর জীবন। সেদিন স্বৈরাচার পতনের এক দফা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন রুবেল ইসলাম। বেলা ১১টার দিকে উত্তাল মিছিল পৌঁছে আদাবর থানার সামনে। সেই মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। এসময় গুলিবিদ্ধ হলে আহত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭ আগস্ট মৃত্যু হয় তার।

ঘটনার পর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও ছেলে হারানোর শোকে এখনও কান্না থামছে না শহীদ রুবেল ইসলামের মায়ের। ছেলের রেখে যাওয়া স্মৃতি মনে পড়লেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে এখনও।

নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের ধোবাডাঙ্গা আরাজীপাড়া গ্রামে শহীদ রুবেল ইসলামের বাড়ি। স্বপ্ন ছিল আয়-রোজগার করে ছোট ভাইকে লেখাপড়া শেখাবেন। কিনবেন বাড়ির ভিটা, গড়বেন পরিবারের স্থায়ী ঠিকানা।

স্বপ্ন পূরণের আশায় চাকরি নিয়েছিলেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়। আর বাবা নেমেছিলেন রিকশা চালানোর কাজে। বাবা-ছেলের জমানো টাকায় ধরতে চেয়েছিলেন অধরা স্বপ্নগুলো। এগিয়ে যাচ্ছিলেন স্বপ্ন পূরণের পথে। ছোট ভাই রনি ইসলামকে পড়াচ্ছিলেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। স্বপ্ন পূরণে মা-বাবাকে নিয়ে বসবাস করতেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায়।

জানা গেছে, দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে শহীদ রুবেল ইসলাম ছিলেন তৃতীয়। লেখাপড়া করেছিলেন সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। তার তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই রনি ইসলাম পড়ছে এলাকার একটি মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে। ঢাকায় অবস্থানের কারণে রনিকে রেখেছিলেন ওই মাদরাসার আবাসিকে।

এরপর একমাত্র অবলম্বন রুবেল ইসলাম আন্দোলনে শহীদ হলে গ্রামে ফিরে আসেন তার বাবা-মা। নিজের বসতভিটা না থাকায় বর্তমানে ছোট ছেলেকে নিয়ে অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন।

শহীদ রুবেলের মা মিনি খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলে আগে ছিল কামাই করছিল সংসার ভালো চলছে। এখন ছেলেও নাই সংসারও চলে না। ছেলে গার্মেন্টসে চাকরি করে সংসার চালিয়েছে নিজে চলছে। আবার মনে আশা পূরণ করতে চাইছে বাড়ি-ঘর করতে চাইছে। ছেলে আর করতে পারলো না। সবাই কিছু সহযোগিতা করছে দেখাশোনা করে গেছে।

বোন রোজিনা আক্তার পিংকি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ও আমার ভাই ছিল না, বাপের তুল্য ছিল। আমাদের কী লাগবে, কী লাগবে না, কী খাব, কী খাব না, সবসময় খোঁজ নিত। আমাদের লেখাপড়াও সে করিয়েছে। আজকে ভাই নাই সব কিছু ফাঁকা। আজ ভাই থাকলে এতো কষ্ট করতে হতো না। ভাইয়ের অনেক আশা ছিল জমি জায়গা কিনবো মা-বাবাকে সুখ শান্তিতে রাখবো। কিন্তু ভাইয়ের আশা পূরণ হলো না। 

চাচা শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রুবেলে বাবা অসুস্থ। কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। রুবেল মারা যাওয়ার পর নীলসাগরে একটা চাকরি দিয়েছে। ওখানে কষ্ট করে ডিউটি করে সংসারটা চালায়। আমার ভাতিজা যে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করলো আমাদের সংসারটার কোনো উন্নতি হয় নাই। বরং আরও খারাপ অবস্থায় সংসার চলছে।

বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, আদাবর এলাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন রুবেল ইসলাম। রাতের ডিউটি থাকায় সেখান থেকে প্রতিদিন সকালে বাড়িতে ফিরতেন। তাকে রেখে তিনি নিজে বেরিয়ে যেতেন রিকশা চালানোর কাজে। ৫ আগস্ট ফিরতে দেরি হওয়ায় সকাল নয়টার দিকে ফোন করে খবর নেন ছেলের। এরপর বাসায় এসে বেলা ১১টার দিকে যোগ দেন আন্দোলনে।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ছেলে ফোনে বলেছিল, আব্বা, কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় আসছি। কথাটা শুনে নিশ্চিন্ত মনে রিকশা চালাইতে গিয়েছিলাম। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে খবর পাই, ছেলে মিছিলে গিয়েছিল, আদাবর থানার সামনে গুলি লেগে আহত হয়েছে। তারপর হাসপাতাল গিয়ে দেখি, ওর অপারেশন শুরু হয়েছে।

তিনি জানান, চিকিৎসা চলার পর ৭ আগস্ট শ্যামলীর সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে মৃত্যু হয় তার। এরপর সেখান থেকে গ্রামের বাড়িতে লাশ এনে রাত সাড়ে নয়টার দিকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

বিভিন্ন সহযোগিতার প্রসঙ্গে বাবা রফিকুল ইসলাম জানান, লাশ আনার সময় ২৫ হাজার, জেলা প্রশাসন ৩০ হাজার, আসসুন্নাহ ফাউন্ডেশন এক লাখ, জামায়াতের পক্ষ থেকে দেড় লাখ এবং জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার সহযোগিতা পেয়েছেন এ পর্যন্ত। সেই টাকা থেকে চিকিৎসাসহ অন্যান্য খরচ বাবদ দেনা পরিশোধ করেছেন এক লাখ টাকা।

বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার গ্রামের সবাই জানে আমার থাকার ঘরটাও নাই। মেয়ে তিনটাকে বিয়ে দিয়ে ফকির হয়ে গেছি। ছেলে আমার দেশ স্বাধীন করলো, কিন্তু কেউ আসলো না আমার খোঁজও নিলো না। সরকারের কাছে আবেদন হায়াত থাকতে যেন বিচারটা দেখে যেতে পারি। আমার ছেলে সংসারের হালটা ধরছিল আমি রিকশা চালাইদাম সংসারটা ভালোই চলছিল। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে সংসারে খুব অভাব। যে চাকরি করি সেটা দিয়ে চলে না। 

গোড়গ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহীদ রুবেল ইসলামের পরিবারের খোঁজখবর রাখছি আমরা। আমাদের সুপারিশে তার বাবাকে এলাকার নীলসাগর গ্রুপের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আহসান হাবিব লেলিন চাকরি দিয়েছেন। পরিবারটির কষ্ট লাঘবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

গোড়গ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেয়াজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পরিবারটি একেবারেই অসহায়। ছেলের অকাল মৃত্যু পরিবারটিকে আরও অসহায় করেছে। আমরা সকলে পাশে থেকে সেই ঘাটতি পূরণ করতে চাই।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নীলফামারীতে আহত হয়েছেন ১৫৯ জন ছাত্র জনতা। তাদের মধ্যে অঙ্গহানিও হয়েছে বেশ কয়েকজনের। সেই সময়কার আন্দোলনে যোগ দিয়ে জীবন প্রদীপ নিভে গেছে চারজনের। তবে তারা কেউই নীলফামারীতে শহীদ হননি। নিহত হয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। নিহতদের মধ্যে চারজনই ছিলেন কর্মজীবী। টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে না পেরে অল্প বয়সেই সংসারের হাল ধরেছিলেন তারা। নীলফামারীর চার শহীদ পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ও আহতদের ১৫৯ জনের প্রত্যেককে এক লাখ করে টাকা দিয়েছে জুলাই ফাউন্ডেশন। এছাড়াও আহত ও নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

এমএএস