নিহত ছাত্রদল কর্মী ইপ্সিতার বাবা
‘পরিকল্পিতভাবে আমার মেয়েকে লঞ্চে নিয়ে হত্যা করেছে’
নিহত সুকর্ণা আক্তার ইপ্সিতা
লক্ষীপুরের মেঘনা নদী থেকে মরদেহ উদ্ধারের চার দিন পেরিয়ে গেলেও ভোলা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল কর্মী সুকর্ণা আক্তার ইপ্সিতার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। নৌপুলিশ মরদেহ উদ্ধারের পর অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছে। পরিবারের দাবি- এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
ইপ্সিতার মরদেহ শনাক্তের বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেন তার বাবা মাসুদ রানা। ইপ্সিতা ভোলা সদর উপজেলার হাসপাতাল রোডের নবীপুর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাসুদ রানা ও ইয়ানুর বেগম দম্পতির বড় মেয়ে। ভোলা সরকারি কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
মরদেহটি গত শুক্রবার (২১ জুন) অর্থাৎ নিখোঁজের চার দিন পর উপজেলার বুড়িরঘাট এলাকায় মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করে লক্ষীপুর মজু চৌধুরীঘাট নৌপুলিশ। তার মৃত্যুকে ঘিরে ভোলার সর্বমহলে নেমে আসে শোকের ছায়া। শুরু হয় নানা রকম মুখরোচক আলোচনা। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের কাছে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনার উন্মোচন ও ইপ্সিতার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। অন্যদিকে সহযোদ্ধার মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনের কাছে সঠিক তদন্ত ও জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা।
পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়েরের পাশাপাশি লক্ষ্মীপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন ইপ্সিতার বাবা মাসুদ রানা। তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, জনৈক মেহেদী হাসান বাপ্পি নামে এক ব্যক্তির সাথে আমার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। যখন ইপ্সিতা জানতে পারেন সে বিবাহিত তখন প্রেমের সম্পর্ক অবনতি হয় এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে মেহেদী হাসান বাপ্পি ইপ্সিতার পারিবারিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।
বিজ্ঞাপন
তিনি অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর চরফ্যাশন উপজেলার আঞ্জুরহাটের বাসিন্দা মো. নুর নবীর ছেলে মো. মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় ইপ্সিতার। ইপ্সিতা পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় এখনো তাকে তুলে দেননি। ৫-৬ মাস আগে কোনো কারণ ছাড়াই ইপ্সিতাকে ডিভোর্স দেন মেহেদী হাসান মিরাজ। বিষয়টি নিয়ে ইপ্সিতা বাদী হয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। পারিবারিক আদালতে মামলা করার পর মেহেদী হাসান মিরাজ ইপ্সিতা ও তার বাবার বিরুদ্ধে চরফ্যাশন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যজিস্ট্রেট আদালতে একটি সিআর মামলা করেন। এরপর থেকে মেহেদী হাসান ইপ্সিতা ও তার বাবাকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেয়। পরে ইপ্সিতার বাবা বাদী হয়ে ভোলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি এম.পি মামলা করেন। মামলাগুলো চলমান রয়েছে।
আরও পড়ুন
মাসুদ রানা অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ইপ্সিতা গত ১৭ জুন সকাল ৮টার দিকে বাসা থেকে প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে আর ফেরত না আসায় তিনি বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও পাননি। এরপর থেকে তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি ২০ জুন ভোলা সদর থানায় জিডি করেন এবং ঘটনার পর থেকে তারা চতুর্দিকে খোঁজখবর নিতে থাকেন। পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে জানতে পারেন ১৭ জুন ভোলার ইলিশা লঞ্চঘাট থেকে ঢাকাগামী এমভি কর্নফুলী-৪ লঞ্চের ৩৫৯ নম্বর কেবিনের এক যাত্রী (মেয়ে) লঞ্চ থেকে পানিতে পড়ে মারা গেছে। তার মরদেহ ২১ জুন লক্ষ্মীপুর মজু চৌধুরীরঘাট নৌপুলিশ উদ্ধার করে। পরবর্তীতে নৌপুলিশ বাদী হয়ে লক্ষ্মীপুর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা করে। তার মেয়েকে কে বা কারা কৌশলে গত ১৭ জুন থেকে ২০ জুনের মধ্যে হত্যা করে মরদেহ গুমের উদ্দেশে লঞ্চ থেকে মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়। তিনি বিচারের দাবি জানান।
নিহত ইপ্সিতার বাবা মাসুদ রানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিদিনের মতো ১৭ জুন সকালে প্রাইভেট পড়াতে যাচ্ছে বলে তার মাকে জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় ইপ্সিতা। প্রাইভেট পড়ানো শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে ফেরেনি। দুপুর ১২টার দিকে তার মা তার ব্যবহৃত মোবাইলে কল দিলে রিং বাজলেও সে ফোন রিসিভ করেনি। এভাবেই বিকেল গড়িয়ে রাত নামলেও ইপ্সিতা মোবাইল রিসিভ করেনি। ১৮ তারিখ বিকেল থেকে তার মোবাইলে আর কল ঢোকেনি। আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও তার বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়ে তার সন্ধান পাইনি এবং ভোলা সদর থানায় জিডি করি। পরবর্তীতে জানতে পারি ঢাকা যাওয়ার পথে কর্ণফুলী-৪ লঞ্চ থেকে একটি মেয়ে পড়েছে, সে সূত্র ধরে খুঁজতে খুঁজতে লঞ্চে গিয়ে জানতে পারি সে মেয়েটি আমার মেয়ে। পরবর্তীতে লক্ষ্মীপুরে অজ্ঞাত মরদেহ উদ্ধারের খবরে সেখানে গিয়ে পোশাক দেখে আমার মেয়ের মরদেহ শনাক্ত করেছি। এর আগে পরিচয় শনাক্তে দেরি হওয়ায় পুলিশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে ইপ্সিতার মরদেহ দাফন করায়।
তিনি বলেন, স্টুডেন্টদের প্রাইভেট পড়াতে গিয়ে ইপ্সিতা কীভাবে কার সাথে লঞ্চে গেল? পরিকল্পিতভাবে আমার মেয়েকে লঞ্চে নিয়ে হত্যা করেছে। কে-বা কাহারা আমার মেয়েকে হত্যা করেছে তা আমি জানি না,পুলিশ ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পেয়েছে এবং পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেছে। আমার মেয়ে হত্যার বিচার না হলে হত্যাকারীরা এভাবেই হত্যা করতে থাকবে। আমি এ হত্যার বিচার চাই।
কর্ণফুলী লঞ্চ কোম্পানির ম্যানেজার (মেসার্স ব্রাদার্স নেভিগেশন) মো. আলাউদ্দিন বলেন, ১৭ জুন সকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়ার আগে ওই তরুণী লঞ্চে কেবিন নিতে চান এবং পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তাকে কেবিন দেওয়া হয়নি। পরে সে ডেকে চলে যান। লঞ্চ ইলিশাঘাট থেকে ছেড়ে কালিগঞ্জ পেরিয়ে মেঘনারচর নামক এলাকায় পৌঁছালে এক তরুণী লঞ্চের ৩ তলা থেকে নদীতে ঝাঁপ দেন। লঞ্চে থাকা অন্যান্য যাত্রীদের চিৎকারে লঞ্চ স্টাফরা প্রায় ৪৫ মিনিট উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েও তাকে পাননি। পরে প্রশাসনকে অবহিত করে লঞ্চটি ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এছাড়া মুন্সিগঞ্জ থানা পুলিশ লঞ্চ আটকে দুই স্টাফ ও ৯৯৯ এ কল দেওয়া ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়।
ভোলা সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু শাহাদাৎ মো. হাচনাইন পারভেজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইপ্সিতা গত ১৭ জুন নিখোঁজ হন। তার বাবা থানায় জিডি করেন ২০ জুন। মামলাটি লক্ষ্মীপুর পুলিশ তদন্ত করছে।
লক্ষীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) ঝলক মোহন্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ঘটনায় মজু চৌধুরীঘাট নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আজিজুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেছেন। ইপ্সিতার বাবা একটি অভিযোগ দিয়েছেন, তদন্ত চলছে।
খাইরুল ইসলাম/আরএআর