সংগৃহীত

দেশের পশ্চিম কোণে অবস্থিত চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এটি প্রাচীনবাংলার গৌর জনপদের অংশ ছিল। আমের জন্য দেশব্যাপী খ্যাতি রয়েছে চাপাইনবাবগঞ্জের। তবে শিল্প ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই জেলাটি। চাপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে ‘আলপনা গ্রাম’ নামের এক অনন্য গ্রাম। যা এই জেলায় এনে দিয়েছে যেন শিল্পের ছোঁয়া। 

চাপাইনবাবগঞ্জ উপজেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের টিকইল গ্রামটিই মূলত আলপনা গ্রাম নামে পরিচিত। যে গ্রামের প্রায় সব নারীই শিল্পী। গ্রামের অতীত ইতিহাস বেশ স্পষ্ট নয়, সরাসরি কোনো নথি নেই যে ঠিক কোন সময় থেকে এখানে আলপনা আঁকা শুরু হলো। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে গ্রামটি দেশের মানুষের কাছে পরিচিত।

গ্রামের ঘরগুলো মাটির ভিত ও মাটির দেওয়ালের ওপরে টিনের আচ্ছাদনে তৈরি। মাটির বাইরের দেওয়াল থেকে শুরু করে ভেতরের ঘর, প্রতিটি দেওয়ালেই আলপনা করা। এই গ্রামে বসবাসরত চার শতাধিক মানুষের মধ্যে প্রায় ৮০টি পরিবার সনাতন ধর্মাবলম্বী। তারা সবাই বর্মণ পদবির। তাদের হাত ধরেই গ্রামটির নাম ‘আলপনা গ্রাম’। 

আলপনা গ্রামটি ঘুরে দেখা গেছে, এখানে ৭০ থেকে ৮০টি পরিবার বসবাস করে। এর মধ্যে মোট ৪০ থেকে ৫০টি পরিবারের ঘরে আলপনা আঁকা রয়েছে। এ গ্রামের বাসিন্দারা আলপনাকে এলাকার একটি ঐতিহ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। গ্রামের বউ, ঝি’রা আলপনা আঁকতে আঁকতে নিঃশব্দে এবং নিজের অজান্তে এক একেক জন শিল্পী হয়ে উঠেছেন। ঘরের দেয়াল-মেঝেই তাদের কারুকাজ করার ক্যানভাস। প্রতি বাড়ির উঠোন থেকে রান্নাঘর, দেয়াল, বারান্দা সবই এই নারীদের নিপুণ আঁচড়ে রঙিন হয়ে ওঠে।

কেনা রঙের পাশাপাশি তারা ব্যবহার করেন খড়ি মাটি, আতপ চালের গুড়া, আমের খোসার গুড়া, কলাগাছের ছাল দিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে মিশিয়ে তৈরি বিভিন্ন রঙ। রঙ করতে বিভিন্ন তুলির পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে হাতের আঙ্গুলসহ হাত। 

আলপনা গ্রামের প্রতি ঘরের বারান্দা ও দেয়াল যেন খোলা ক্যানভাস। যেখানে লাল, নীল, সবুজ, সাদা রঙের অলঙ্কারে প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছে এ অলপনা শিল্পে। যেমন- পদ্ম ফুল, লতা-পাতা, ধানের শীষ, দেবী লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, মাছ, শঙ্খ ইত্যাদি। সাধারণত উৎসব, পূজা, ব্রত এবং অন্যান্য শুভ অনুষ্ঠানে ঘর, উঠান এবং দরজার চৌকাঠে আলপনা আঁকা হয়। 

আলপনা বিষয়টি আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বাঙালির আলপনা শিল্প একটি ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্প। সংস্কৃত শব্দ ‘আলিম্পন’ আলপনা শব্দটি বাংলা ভাষায় জায়গা করে নিয়েছে। যার অর্থ প্রলেপ দেওয়া বা লেপন করা। এটি মূলত বাঙালি নারীদের একটি আচার-অনুষ্ঠান। এটি বাঙালি নারীর সৃজনশীলতা ও শৈল্পিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ।

টিকইল গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমেই সবার দৃষ্টি কাড়ে গ্রামের প্রবীণ আলপনা শিল্পী শ্রীমতী দেখন বর্মনের (৬৪) বাড়ি। দেখন বর্মন প্রায় ৪৫ বছর আগে এ গ্রামে পুত্রবধূ হয়ে এসেছিলেন। তার স্বামীর নাম বাসুদেব বর্মন। তিনি সম্প্রতি মারা গেছেন। তিন মেয়ের মা দেখন বর্মন।

দেখন বর্মনের মেয়ে জয়া বর্মন প্রতিবেদককে (৩৪) জানান, এই গ্রামে আলপনা শিল্পকে জনপ্রিয় করে তুলেছেন তার মা দেখন বর্মন। দীর্ঘজীবনে তার ঘরের মাটির দেয়ালগুলোতে সাদা এবং রঙিন আলপনা এঁকেছেন, এরপর তার মেয়েরাও মায়ের ঐতিহ্য গ্রহণ করেছেন। দেখন বর্মণের বাড়িতে রাখা আছে একটি ভ্রমণ বই। সেখানে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ যায় এবং দীর্ঘ সফর শেষে আলপনা আঁকা এসব বাড়ির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে নানান অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

দেখন বর্মন, অনিতা বর্মন এবং তাদের সহকর্মীরা প্রয়োজনে সপ্তাহের বিশেষ সময়ে বা বছরের নানান পূজা-পার্বণে ঘরে ঘরে আল্পনা আঁকেন। গ্রামীণ জনপদটির সব বধূ-কন্যারা বছরের পর বছর ধরে এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন।

তবে স্থানীয়রা জানান, কয়েক প্রজন্ম আগে থেকেই এখানে দুর্গা, লক্ষ্মী, কালীপূজা ও নবান্ন উৎসবে প্রতি বাড়িতেই আলপনা আঁকা হয়ে আসছে। শ্রীমতি দেখন বর্মনের মতো প্রবীণ শিল্পীর হাত ধরেই এ কাজ আরও ছড়িয়ে পড়ে গ্রামজুড়ে। বর্তমানেও এলাকার সব নারীই উৎসবে উদ্দীপ্ত হয়ে দেয়াল পালিশ করেন, প্রতিটি পবিত্র অনুষ্ঠানে এখানে আলপনা আঁকা হয়। কয়েক মাস যাওয়ার পর আঁকা আলপনার রঙ ফিকে হয়ে এলে আবার নতুন করে রঙ করে ঝকঝকে করে তোলা হয়।

মাটির দেয়ালগুলো জলবায়ু প্রতিরোধী, তাই আঁকা অলঙ্কারও টেকসই হয়। গ্রামবাসীরা মনে করেন এই সুন্দর আলপনা শুধু মন প্রফুল্লই করে না, বরং ঘরেও পবিত্রতা আনে। তবে ওই গ্রামের ইতোমধ্যে আধুনিকতার ছাপ পড়তে শুরু করেছে। অনেকে মাটির দেওয়াল বাদ দিয়ে আরামদায়ক আধুনিক ইটের ঘরও নির্মাণ করতে শুরু করেছেন। 

তবে গ্রামের মাটির দেয়ালগুলোতে আলপনার এই শৈল্পিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার ইচ্ছা এখানকার বসবাসরতদের। 

আরকে