ভেঙে ফেলা ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি নয়, জানালেন ডিসি
ময়মনসিংহে জমিদারি আমলের শতবর্ষী ঐতিহাসিক শিশু একাডেমির ভেঙে ফেলা ভবনটি বিশিষ্ট নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি নয়, বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মুফিদুল আলম। তিনি আরও বলেন, মূলত একটি গোষ্টি দেশের সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য এই বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
বুধবার (১৬ জুলাই) বিকেল ৫টায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ ঘটনায় উদ্ভুত পরিস্থিতিতে নগরীর বিশিষ্টজনদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের এক জরুরী সভা শেষে সাংবাদিকদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিসি মুফিদুল আলম।
বিজ্ঞাপন
তিনি আরও বলেন, শিশু একাডেমির যে ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি বলে দাবি করা হচ্ছে, মূলত তা সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি নয়। প্রথমত সংশ্লিষ্ট সকল খতিয়ান এবং রেকর্ডপত্র যাচাই করেছি, সিএস, আরএসসহ সকল খতিয়ানে কোনোভাবেই সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবারের নাম নেই। আরএস রেকর্ডে এটি বাংলাদেশ সরকারের নামে লিপিবদ্ধ। ২০০৮ সালে এটি বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির নামে এটি বন্দোবস্ত করা হয়েছে এবং তাদের নামে জমির দলিল বন্দোবস্ত করা হয়েছে, এর খতিয়ান আছে। এরপর তারা যথাযথ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে এই ভবনটি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে তারা কোনো নিয়মের ব্যতয় ঘটাননি। দ্বিতীয়ত, এই ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি ছিল কীনা এবং তার পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল কী-না, যেটা দাবি করা হচ্ছে। সেই বিষয়ে আমরা নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা কঠোরচিত্তে বলেছেন যে, এটি কখনো সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি ছিল না। ইচ্ছাকৃতভাবে একটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের দেশের ভাবমূতি ক্ষুণ্ন করার জন্য এই তথ্যগুলো ছড়ানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটি সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি না বা তারা কখনও এই বাড়িতে ছিলেন না। তারা যে বাড়িটিতে থাকতেন সেটি পূর্ণলক্ষী নামক পাশের একটি বাড়ি। তারা (বিশিষ্টজনরা) সে বাড়িটি চেনেন। প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ বা অন্য কেউ চাইলে তারা সেই বাড়িটি দেখিয়ে দিতে পারবেন।
এ সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রফেসর বিমল কান্তি দে, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার ও কথা সাহিত্যিক ফরিদ আহাম্মেদ দুলাল, বিশিষ্ট শিক্ষক ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ইতিহাস সংরক্ষক স্বপন ধর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমির অতিরিক্ত সচিব শিউলী রহমান তিন্নীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ।
বিজ্ঞাপন
সভায় প্রফেসর বিমল কান্তি দে বলেন, শিশু একাডেমির ভাঙা ভবনটিতে থাকতেন তৎকালীন জেলা পরিষদের সচিব সারোয়ার জাহান চৌধুরী। পরবর্তীতে একই প্রতিষ্ঠানের সচিব শাকির আহম্মেদ থাকতেন এই ভবনটিতে। এরপর এটি শিশু একাডেমিকে দেওয়ার বেশ কয়েক বছর পর এটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এই বাড়িতে সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবার থাকতো তা কখনো কেউ বলেনি। শুধুমাত্র অমূলক ধারণা থেকে এই তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
এ সময় স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার ও কথা সাহিত্যিক ফরিদ আহাম্মেদ দুলাল বলেন, না জেনে তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। ভেঙে ফেলা শিশু একাডেমির ভবনটির পাশে পূর্ণলক্ষী নামক ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি। তবে এই বাড়িটি হাত বদল হওয়ার পর এক তলা থেকে বর্তমানে দুই তলা করা হয়েছে। রনদা প্রসাদ সাহা এটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি না। কিন্তু না জেনে অনেকেই এটি নিয়ে উল্টাপাল্টা বলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছেন।
সভায় বিশিষ্ট শিক্ষক ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ইতিহাস সংরক্ষক স্বপন ধরও তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ভাঙা ভবনটি শতবর্ষী পুরোনো স্থাপত্য। এটি রনদা প্রসাদ সাহার বাড়ি। এটি নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় সম্পদ।
তিনি আরও জানান, ময়মনসিংহ জেলায় ৩২০টি ঐতিহাসিক স্থাপত্য ছিল। এর মধ্যে ৪০টি স্থাপত্যের অস্থিত্ব এখন আর নেই। বাকি ২৮০টির মধ্যে ৬টি আন্তর্জাতিক মানের, ৫৪টি দ্বিতীয় ক্যাটাগরির এবং ২২০টি সি-ক্যাটাগরির স্থাপত্য রয়েছে। এগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা অতিব জরুরী।
এর আগে গতকাল (১৫ জুলাই) ময়মনসিংহ নগরীর হরিকিশোর রায় রোডস্থ শিশু একাডেমির এই ভবনটি ভাঙা হলে এটি ভারতীয় বিশিষ্ট নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি বলে একাধিক শীর্ষ সারির সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ময়মনসিংহ সিটি গ্রুপ নামক একটি পেইজ থেকে এই খবরটি প্রচার করা হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলে ঘটনাটি গড়ায় ভারতেও।
প্রসঙ্গত, ঘটনাটি সংবাদ মাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিবিজরিত বাড়িটি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ভেঙে ফেলছে। বাংলাদেশ সরকারকে এ সিদ্ধান্ত পুর্নবিবেচনার আহ্বান জানান তিনি। এ সংক্রান্ত একটি খবর ভারতীয় এনডিটিভিতে প্রচারের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়।
আমান উল্লাহ আকন্দ/এমএএস