বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে পুরুষদের পাশাপাশি সম্মুখ সারির লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিলেন সাতক্ষীরার নারীরাও। গুলির মুখেও থামেনি তাদের দ্রোহের পদযাত্রা। শুধু রাজপথ নয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্দোলনে নতুন উদ্দীপনা যোগ করে।

সাতক্ষীরায় আন্দোলনের সূচনা হয় ১৩ জুলাই ২০২৪, শহরের খুলনা রোড মোড় থেকে ছোট আকারের বিক্ষোভ দিয়ে। কয়েক দিনের মধ্যে নারকেলতলা মোড়, নিউ মার্কেট মোড়সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ১৭ জুলাই ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশের টিয়ারশেলে বহু শিক্ষার্থী আহত এবং ৩৫ জন গ্রেপ্তার হলেও আন্দোলন থামেনি। 

১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাতক্ষীরার দেবহাটার আস্কারপুর গ্রামের ছাত্র আসিফ হাসান। যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এরপর কিছুদিন বিরতির পর কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৩ আগস্ট বেলা ১১টায় খুলনা রোড মোড়ে হাজারো শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কৃষক, শ্রমিক, নারী-পুরুষ ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরদিন ৪ আগস্ট (রোববার) সাতক্ষীরার রাজপথ দখল করে নেয় ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাজার হাজার শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এদিনের বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন। বেলা ১১টায় খুলনা রোড মোড় থেকে বিশাল মিছিল বের হয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে নিউ মার্কেট মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখানে আন্দোলনকারীরা শেখ মুজিবুর রহমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ছবি সম্বলিত ব্যানার ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলে। 

৫ আগস্ট সকাল ১০টার পর থেকে কারফিউ ভেঙে সাতক্ষীরার সাতটি উপজেলা থেকে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, অভিভাবক, কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ ছাত্র-জনতার কাতারে রাস্তায় নেমে আসেন। সকালে নারকেলতলা মোড় থেকে খুলনা রোড মোড়ে এসে শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়। পুলিশ সুপার মতিউর রহমান সিদ্দিকী তাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলের অনুরোধ জানান। পরে মিছিলটি নিউ মার্কেট এলাকা হয়ে আবারও খুলনা রোড মোড়ে ফিরে বিক্ষোভ সমাবেশে মিলিত হয়। দুপুরের পর সংবাদ আসে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে—এ খবরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায়। বিক্ষুব্ধ জনতা পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় এসপি বাংলোতে ভাঙচুর চালায়। তখন আবারও পুলিশের গুলিতে বহু শিক্ষার্থী আহত হয়। এই ঘটনায় সাতক্ষীরায় ৯৭ জন শিক্ষার্থী আহত এবং শহীদ আসিফসহ ৪ জন নিহত হন।

নারী নেতৃত্বে গর্জে উঠেছিল সাতক্ষীরা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি সাহসিকতার চূড়ান্ত নজির গড়েছে সাতক্ষীরার নারীরা। তারা শুধু মিছিলে ছিলেন না—ছিলেন নেতৃত্বে, সামনে, স্লোগানে, সংঘর্ষের মুখে। পথে পথে, কলেজ ক্যাম্পাসে, পাড়া-মহল্লায় নারী শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টলাইন। কেউ সংগঠক, কেউ ব্যানার হাতে স্লোগান দিয়েছেন, কেউ মোবাইল ক্যামেরা হাতে ছুটেছেন। রাজপথে স্লোগান চলছিল নারী-পুরুষ এক কাতারে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের এই গর্জন শুধু ছাত্রদের নয়, সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, অভিভাবকদেরও সাহস জুগিয়েছে।

আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী তিন নারী যোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র মোহিনী তাবাসসুম। আন্দোলনের শুরু থেকেই সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মিছিল, সভা, পথসভাসহ সব কর্মপরিকল্পনায় তার অংশগ্রহণ ছিল নিরলস। মোহিনী তাবাসসুম বলেন, আওয়ামী লীগপন্থি মানুষজনের কাছ থেকে নানারকম হুমকি আসত। কেউ বলত—মেয়ে হয়ে আন্দোলনে যাচ্ছ, টিকে থাকতে পারবা? সারাদিন অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসত, ছাত্রলীগ বা ক্ষমতাসীনদের সমর্থকরা ধর্ষণ, খুনসহ সব ধরনের হুমকি দিত। তবুও পিছপা হইনি, কারণ দাবি ছিল যৌক্তিক। সাহসের সঙ্গে সম্মুখ সারিতে থেকে আন্দোলন সংগঠিত করেছি।

তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে সাতক্ষীরার মেয়ে শিক্ষার্থীদের অবদান ছিল অসামান্য। আমি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ এবং সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। স্কুল ও কলেজের গ্রুপে মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনভিন্স করেছি আন্দোলনে যোগ দিতে। প্রত্যেকেই আমার কথায় সাড়া দিয়েছে।

সাতক্ষীরা আলিয়া কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সক্রিয় নারী সালেহা জান্নাত। তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় যেদিন আন্দোলন শুরু হয় সেদিনই যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরিবারের একজন হাসপাতালে ভর্তি থাকায় পারিনি। হসপিটালে বসে শহীদ ভাইদের ফুটেজ দেখে স্থির থাকতে পারিনি। ১৮ জুলাই প্রথম শহীদ আসিফ চত্বরে আন্দোলনে যোগ দিই।

তিনি বলেন, আমার ভূমিকা নিয়ে গর্ব করি না, কারণ কৃতিত্ব সব শহীদ ভাইদের, যারা জীবন দিয়েছেন। তবে চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। ১৮ জুলাই আন্দোলনে এসে পুলিশের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়, মিডিয়াতে আসে—এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগের শত্রু তালিকায় পড়ি। নানা মানসিক চাপ, হুমকি এসেছিল। কিন্তু শহীদ ভাইদের রক্ত আমাদের রাজপথে ডাকত।

তার পরিবারও তাকে সমর্থন করেছে। ‘আমার মা ছিলেন সবচেয়ে বড় সাহসের উৎস। অনেক মায়েরা সন্তানকে আটকে রেখেছেন, কিন্তু আমার মা আন্দোলনে পাঠিয়েছেন। তিনি বলতেন, হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে, গুলির মাঝেও যদি হায়াত থাকে ফিরবে, না থাকলে ঘরে বসিয়ে রেখেও বাঁচবে না। আমাদের পুরো পরিবার আন্দোলনে ছিল।’

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী তইবা তাবাসসুম বলেন, আমার ভাইবোনেরা রাস্তায় নির্যাতিত হচ্ছে এই কষ্ট থেকেই ১৪ জুলাই সরকারি কলেজে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিই। ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামি। কলেজ গেটে আসতেই ছাত্রলীগ বাধা দেয়, ভিডিও করে, ভয় দেখায়। তবুও আমরা নারকেলতলা মোড়ে গিয়ে মিছিল শুরু করি।

তিনি বলেন, ১৭ জুলাই নারকেলতলা থেকে বিপুল শিক্ষার্থী খুলনা রোডে গেলে ছাত্রলীগ ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। কেউ ভয় পেয়ে সরে যায়, তবে কিছু শিক্ষার্থী লাঠি-সোটা নিয়ে পাল্টা ধাওয়া করে তাদের প্রতিহত করে।

শুধু এই তিনজন নয়, তাদের মতো হাজারো নারী শিক্ষার্থী, গৃহবধূ, শ্রমজীবী নারী এক কাতারে নেমে এসেছিলেন সাতক্ষীরার রাজপথে। তারা প্রমাণ করেছেন—এই দেশের গণআন্দোলনে নারীরাও নেতৃত্ব দিতে জানে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সাতক্ষীরার নারীদের গর্বিত অংশগ্রহণেরও একটা ইতিহাস।

আরকে/জেএস