পাবনার শহীদ নিলয়ের মা
‘হাসপাতালে গিয়ে দেখি পতাকা দিয়ে আমার ছেলের লাশ মুড়িয়ে রেখেছে’
‘দুই ছেলে ও এক মেয়েকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিজেই পাঠিয়েছিলাম। বড় মেয়ে ঢাকার রাজপথে লড়াই করেছে। তিনজন বাড়িতে আসল কিন্তু ছোট্ট নিলয়ের নিথর দেহ বাড়িতে ফিরেছিল। এলাকার নারীদেরও সরকার বিরোধী হয়ে রাজপথে নামার অনুরোধ করেছিলাম। এরই মাঝে খবর এলো হাসপাতালে পড়ে আছে আমার ছোট ছেলেটা। খবর পেয়ে পাশের দোকান থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ছেলের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম।’
সোমবার (৪ আগস্ট) বিকেলে শহীদ মাহবুব হাসান নিলয়ের মা দিল আফরোজা বেগম ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধির সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, নিলয় শহীদ হওয়ার ৬ মাস আগেও বলেছিল ‘ফিলিস্তিনের যুদ্ধ যদি বাংলাদেশে আসত তাহলে আমি অংশগ্রহণ করতাম।’ এ কথা আমাকে বললে আমি বলেছিলাম দেশের জন্য তো লড়তেই হবে। তোমার মামারা ইসলামের জন্য সেই ঢাকা টুঙ্গী পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গেছিল। এরপর ঢাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলো। আমাকে বলতেছে আম্মা ঢাকা থেকে ফিরে এসে বোধহয় ভুল করলাম। দেখ আজকে জমজ ভাইদের একজন (মুগ্ধ) মারা গেছে। তখন আমি বললাম আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাই হয়েছে।
‘পরে ১৮ জুলাই থেকে পাবনায় আন্দোলন শুরু হলে নিলয় তার পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের (প্রাইভেট শিক্ষক) কাছে বলে যে স্যার আন্দোলনে গেলে আমাকে নিয়ে যাবেন। প্রয়োজনে আমার আম্মাও যাবে। এরপর প্রাইভেট স্যার বলে যে আন্টি আপনিও নাকি আন্দোলনে যাবেন। তখন আমি বলি দেশের জন্য প্রয়োজন হলে যেতেই হবে।’
বিজ্ঞাপন
‘ওই দিন শহরে গিয়েছিল। পুলিশের টিয়ারগ্যাসে বাড়ির সামনে এসে গ্যাস লাইট খুঁজতে থাকে। গিয়ে দেখি মুখে গ্যাস লাইট দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছে। পরে সে বলে যে আমার স্যার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। তাকে বাসায় দিয়ে আসতেছি। পরেরদিন আবারও আন্দোলনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। শহরে গিয়ে এক ঘণ্টা পর ফিরে আসে। আমি বলি, কেমন আন্দোলন? যে এতো তারাতাড়ি শেষ হয়ে গেল। সে বলে যে বড় ভাইরা চলে গেল এজন্য আমিও চলে আসলাম। পরে দেখা যাবে।’
দিল আফরোজা আরও বলেন, ৩ আগস্ট রাতে বাড়িতে সবাই বসে আলোচনা করতেছি তখন তার বাবা বাড়িতে ডুকেই বলতেছে আগামীকাল শহরে আন্দোলনে যেও না। ত্রিমুখী সংঘর্ষ হবে। তখন নিলয় তার বাবাকে বলে তুমি ঘরে বসে থাকো। প্রয়োজনে আমার মাকে নিয়ে আন্দোলনে যাব। তখন আমি বলি যে ভয় করলে চলবে না। আন্দোলনে যেতেই হবে। মানুষের মুক্তি হতেই হবে।
‘৪ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে সে বলতেছে, আম্মু আজকে তোমাকে যেতে হবে না। আজকে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
তখন আমার থেকে দাঁ নিয়ে বাসার ছাদের ওপর গিয়ে তিনটি বাঁশের লাঠি বানায়। এরপর একজনকে ডেকে বলে যে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকো আমার স্যার যাওয়ার সময় স্যারের কাছে লাঠি ৩টা দিও। এরপর নিলয় গ্রামের লোকজনকে ডাকতে গেছে যে আন্দোলনে যেতে হবে। তখন আমি পাড়ার মহিলাদের বলি যে দেশের যে পরিস্থিতি ঘরে বসে না থেকে চলে আন্দোলনে আমরাও যাই। এরপর খবর আসে যে শহরে প্রচুর মারামারি হয়েছে। মানুষ গুলি খাচ্ছে। তখন আমি বাড়ির পাশের দোকান থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে শহর হয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি জাতীয় পতাকা দিয়ে আমার ছেলের লাশ মুড়িয়ে রেখেছে। তখন আমি নিজেই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসি। প্রশাসন ময়নাতদন্ত করতে চাইলে আমি করতে দেইনি।’
তিনি ছেলের প্রশংসা করে বলেন, আমার ছেলে ছোটবেলা থেকেই নামাজ পড়েতো। তাকে নামাজ-রোজার কথা কখনোই বলতে হতো না। পড়াশোনাও ভালো করত। অনেক মেধাবী ছিল। তার মধ্যে বিপ্লবী একটা কিছু ছিল। নম্র-ভদ্র সব দিক দিয়েই ছেলেটা খুব ভালো ছিল। তাকে অনেক যত্নে লালনপালন করেছি। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আল্লাহ তাকে শহিদী মৃত্যু দিয়েছে। আমরা অনেক ভাগ্যবান।
‘শহীদ হওয়ার আগে ছেলেটা জমজ বোনের সঙ্গে ঝগড়া করত। আর বলত আমার জন্য তোমরা অনেক সম্মান পাবে। একদিন মুখ উজ্জ্বল হবে। সারাবিশ্ব মনে রাখবে। যেদিন শহীদ হয় সেদিন সকাল সকালে রান্না করে কাপড়চোপড় পড়িয়ে দিয়েছি। প্রথমে দুইজন চলে যায় শহরে। এরপর নিলয় কচুর শাক দিয়ে ভাত খেয়ে দ্রুত বের হয়ে যায়। আমি তাকে বললাম আজকে গেলে কোনো কিছু হতে পারে, না গেলে হয় না? তখন আমার ছেলে বলে রক্ত ছাড়া দেশ স্বাধীন হয় না। প্রয়োজনে শহীদ হব তবুও কোটা আন্দোলনে যাবই। এটা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের শুরু থেকে পাবনায় যত মিছিল হয়েছে সব মিছিলেই আমার ৪ সন্তান অংশগ্রহণ করেছে। বড় মেয়ে ঢাকার উত্তরাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলন করেছে। আর বাকি দুই ছেলে ও এক মেয়ে পাবনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিছিল মিটিং করেছে।
শহীদ নিলয়ের বাবা আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত মৃত্যুর দুই দিন আগেও নিলয় ফজরের নামাজের জন্য ডেকেছিল। দুজন একসঙ্গেই ফজরের নামাজ আদায় করেছি। ৪ তারিখ সকালে সে বলে যে আমি আন্দোলনে যাব। আমি বললাম, তুমি যেও না। বড় ধরনের ঝামেলায় পড়বা। আমার ছেলে জীবন দিয়েছে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই যে ২ হাজারের মতো শিক্ষার্থী জীবন দিল দেশতো পরিবর্তন হলো না। দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। চাদাঁবাজী দখলদারিত্ব আগের চেয়ে বেড়েছে। এই দেশের মানুষ কোনোদিনও ভালো হবে না।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বৈষম্যবিরোধী নেতারাও এখন আর আগের মতো নেই। তারাও বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েকদিন আগে এনসিপির কেন্দ্রীয় সব নেতারা পাবনায় আসছিলেন। কই আমাদের সঙ্গে তো যোগাযোগ বা দেখা করল না? দুই শহীদের কবরের পাশে তো আসল না?
এই সন্ত্রাস সাঈদ চেয়ারম্যানের তো আরও দশ বছর আগে ফাঁসির আদেশ হয়েছে। এদেশে কোন বিচার নাই। বিচার থাকলে এতোদিন কবে তার ফাঁসি হতো। বর্তমান চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদের বাবা লস্কার খা ও কর্মী মালেক খাকে একই সঙ্গে গুলি করে হত্যার পর প্রধান আসামি থাকা অবস্থায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামানের পাবনায় চরমপন্থিদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সে দলবল নিয়ে যোগদান করেছিল। দেশে তো কোনদিনও বিচার ছিল না।
শহীদ নিলয় হোসেন পাবনা সদর উপজেলার দোগাছী ইউনিয়নের আরিফপুর বেতেপাড়া মহল্লার আবুল কালাম আজাদের ছেলে। শহরের সিদ্দিক মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৯ নবম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাবনা দারুল আমান ট্রাস্টে পড়াশোনা করেন নিলয়। তারা দুই ভাই ও দুই বোন।
নিলয় জমজ ভাই-বোনের একজন। তার জমজ বোন মাহবুবা নাজনীন (১৬) পাবনা সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। বড় বোন ওয়াকিয়া নাজনীন (২৩) ঢাকা বিজনেস ইনস্টিটিউটের তৃতীয় সেমিস্টারে পড়াশোনা করেন। ভাই মাহাদী হাসান লিমন (২৯) পাবনা বাংলামোশন ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমায় পড়াশোনা করেন। বাবা আবুল কালাম আজাদ আনসার একাডেমিতে চাকরি করেন।
পাবনার আন্দোলনে নিহত অপরজন শিক্ষার্থী হলেন- সদর উপজেলার চর বলরামপুর গ্রামের দুলাল উদ্দিনের ছেলে ও পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র জাহিদুল ইসলাম (১৮)। এ ঘটনায় গত শনিবার (১০ আগস্ট) রাতে নিহত পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলামের বাবা মো. দুলাল উদ্দিন মাস্টার বাদী হয়ে পাবনা সদর থানায় মামলা করেন।
মামলায় পাবনা-৫ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সসহ আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ঊর্ধ্বতন নেতাসহ ১০৩ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ১২৩ জনের নাম উল্লেখ করে আরও একটি বিস্ফোরক মামলা হয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ার অভিযোগে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদরের ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু সাঈদকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ৩০ জন গ্রেপ্তার আছেন। আর বিস্ফোরক মামলায় ১১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
পাবনা সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুস সালাম বলেন, পাবনার পুলিশ শহীদ পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অনিরাপত্তায় থাকার সুযোগ নেই। সব সময় খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ৩০ জন গ্রেপ্তার আছেন। আর বিস্ফোরক মামলায় ১১৩ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। দুটি মামলাই তদন্তাধীন রয়েছে। খুব দ্রুতই চার্জশিট গঠন করা হবে।
আরকে