ফাইল ফটো

মানিকগঞ্জে কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ হুমকিতে পড়েছে। কীটনাশকের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন ভয়াবহ চিত্র। বারসিক, MISEREOR এবং Diakonia-এর সহযোগিতায় পরিচালিত এই গবেষণায় জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও উপজেলায় ২১ জন কৃষকের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বেলা ১১টার দিকে মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বারসিক মানিকগঞ্জ রিসোর্স সেন্টার গবেষণার ওপর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। 

বারসিকের গবেষণা বলছে, কৃষকরা বহু বছর ধরে ক্ষতিকর ও সরকারি নিষিদ্ধ কীটনাশক ব্যবহার করে আসছেন। যেমন: কার্বন্ডাজিম, গ্লাইফোসোট, ক্লোরেন্টাডেন, টক্সাফেন ইত্যাদি। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে শুধুমাত্র ফসলের নয়, প্রাণিকুল ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সিংগাইর উপজেলার রাজনগরের কৃষক মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, এক মৌসুমে ৫০ বিঘা জমিতে ‘গন্ডার’ নামক ছত্রাকনাশক প্রয়োগে সরিষা ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়। একইভাবে ভিন্ন কৃষকের ১০টি গরু, ১১টি হাঁস ও একটি পুকুরের মাছ মারা যায়, আনুমানিক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১১ লক্ষাধিক টাকা।

প্রয়োগকারীদের মধ্যে অনেকেই বমি, মাথা ঘোরা, ত্বকে চুলকানি, শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কৃষক মনোয়ার হোসেন বলেন, কীটনাশক প্রয়োগের পর শরীরে তীব্র জ্বালাপোড়া শুরু হয়। 

একাধিক কৃষক জানিয়েছেন, তারা চিকিৎসার জন্য ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ করলেও বড় কোনো চিকিৎসা করান না। গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগির বিষক্রিয়া সম্পর্কিত সমস্যাগুলো হয় আরও মর্মান্তিক। জমির ঘাস খেয়ে একাধিক গরু মারা যায়। হাঁস-মুরগি বিষাক্ত খাবার বা মাছি খেয়ে ছটফট করতে করতে মারা যায়। সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে গোসল করানোর মাধ্যমে কিছু প্রাণী বাঁচানো সম্ভব হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণীগুলো মারা যায়।

গবেষণায় উঠে এসেছে, বেশিরভাগ কৃষক কীটনাশকের গায়ে লেখা সতর্কতা বুঝে উঠতে পারেন না। কেউ কেউ জানতেন এটি ক্ষতিকর, কিন্তু গবাদি পশু বা পরিবেশে এর প্রভাব সম্পর্কে জানেন না। অনেক সময় কীটনাশক ব্যবহারে কারো পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ না থাকলে, কৃষকেরা দোকানদারের পরামর্শেই প্রয়োগ করেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. নাবিলা চৌধুরী বলেন, কীটনাশকের প্রভাবে হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, প্রজনন ক্ষমতা, শিশুদের মানসিক বিকাশ ও জন্মগত ত্রুটি পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে এর ভয়াবহতা আরও বেশি।

ভেটেরিনারি সার্জন ডা. দীপু রায় বলেন, গরু, মাছ, মুরগি সব ক্ষেত্রেই এন্টিবায়োটিক ও কীটনাশক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। যা মানবদেহে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।

নিষিদ্ধ কীটনাশক বাজারে বিক্রি হলেও নজরদারির অভাব রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠালেও বাজারে নিষিদ্ধ কীটনাশক অবাধে বিক্রি হচ্ছে।

তবে কৃষি অফিস সূত্র জানায়, সম্প্রতি কিছু নিষিদ্ধ কীটনাশক চিহ্নিত করে বাজার থেকে প্রত্যাহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে।

বিভিন্ন কৃষক, স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা মত দিয়েছেন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিকল্প চাষ পদ্ধতি ছড়াতে হবে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় কীটনাশক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা দরকার।

গবেষণার সুপারভাইজার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রান্তিক কৃষকের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে নীতিনির্ধারণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের এই সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্র পাঠ করেন গবেষণা সহকারী গাজী নাফিউর রহমান হিমেল। এসময় বারসিক আঞ্চলিক সমন্বয়কারী বিমল চন্দ্র রায়ের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন, বারসিক সভাপতি অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন, মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস, বারসিক কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলামসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা।

সোহেল হোসেন/আরকে